বরগুনা সদর উপজেলার গোলবুনিয়া গ্রামের ১২ বছর বয়সী শিশু হাসি। স্থানীয় কালিরতবক দাখিল মাদরাসার ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ছিল সে। নানা প্রলোভনে তার সঙ্গে ছবি তুলে তা ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে তাকে যৌন নির্যাতন চালাতো এক যুবক। সেই ছবিটি হাতবদল হয়ে পৌঁছে যায় যুবকের বন্ধুদের কাছে। নির্যাতন বাড়তে থাকে হাসির ওপর। নির্যাতন সইতে না পেরে একপর্যায়ে গত ২৯শে আগস্ট রাতে আত্মহত্যা করে মেয়েটি। ‘আমাকে ব্যবহার করবা, এভাবে সরে যাবে তা তো কোনো কথা না। চাইলেই আমাকে ডাকবা, আমিও ভালোবাসার টানে চলে আসবো, তাই না? বিয়ের কথা বললেই তোমার পরিবার অসুস্থ হয়ে যায়, আর…। যৌনদাসী হয়ে গেলাম। ভালো, ভালো আমি সুইসাইড অ্যাটেম্প করছি, তার কারণ হলো নির্ঝর সিনহা রওনক। আমি যদি মারা যাই, তাহলে এর দায় হলো তার। গত ২৪শে মে ভোরে ফেসবুকে এমন স্ট্যাটাস দেয়ার কিছুক্ষণ পর গলায় ফাঁস দিয়ে সত্যি সত্যিই আত্মহত্যা করে বসলেন মডেল কন্যা সাবিরা হোসাইন। ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শারীরিক ও মানসিক চাপের কারণে আমি আত্মহত্যা করলাম।…মরতে বাধ্য করতে পারে।’ এমন সুইসাইড নোট লিখে রেখে গত মাসে আত্মহত্যা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার জাহান (জলি)। হাসি, সাবিরা বা আকতার জাহানই শুধু নন। এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। নানা কারণে নিজেকে খুন করছে মানুষ। বিশেষজ্ঞরা জানান, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক নানা সমস্যা, হতাশা, অপ্রাপ্তি, মান-অভিমান, বিরহ-বিচ্ছেদ, দুঃখ-কষ্ট, রাগ-ক্ষোভ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে বসছে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে উঠতে না পেরে এই অবৈধ ও বেআইনি আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে তারা। উন্নত বিশ্বে আত্মহত্যায় পুরুষের মৃত্যুর হার বেশি হলেও বাংলাদেশে এর চিত্র উল্টো। নানা সামাজিক ও মনো-দৈহিক কারণে নারীর আত্মহত্যার হার বেশি। বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইনজুুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিচার্সের সামপ্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে এদেশে আত্মহত্যাকারীদের ৭৩.৪৫ ভাগই নারী। আর নারীদের মধ্যে ৬২.৮৮ ভাগ গৃহিণী। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আত্মহত্যা কোনোভাবেই নির্যাতিত বা নিগৃহীত হওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও নয়। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও বিরাজমান অবস্থার কোনো পরিবর্তন করতে পারছে না। অথচ হতাশা থেকেই পরিকল্পিত আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে অধিকাংশ আত্মহননকারী। তৎক্ষণাৎ আত্মহত্যার সংখ্যাও কম নয়। আত্মহত্যায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বাংলাদেশ সুইসাইড প্রিভেনশনের মহাসচিব ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাইকোথেরাপি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল মানবজমিনকে বলেন, আত্মহত্যা কোন রোগ নয়। সমস্যা মোকাবিলা করতে না পারার পরিণতি। আত্মহত্যা মানে নিজেকে খুন করা। অন্যান্য খুনের মতো এটিও শতভাগ খুনের অপরাধ। সাময়িক হতাশা ও রাগ-অভিমান থেকে নিজেকে খুন করে বসা শুধু অযৌক্তিকই নয়, সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অনৈতিকও। কোনো ধর্মই আত্মহত্যাকে সমর্থন করে না। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষকে তার সামনে আসা সব সমস্যার সমাধান করেই বেঁচে থাকতে হবে। আত্মহত্যায় কোনো সমাধান নেই। আত্মহত্যা প্রতিবাদের কোনো ভাষাও নয়। ইসলামে তো আত্মহত্যাকারীর জানাজা পর্যন্ত নিষেধ করা হয়েছে। তবে সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে নানা অনৈতিকতা ও সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে এবং হতাশা থেকে মানসিক সমস্যা ও আত্মহত্যার হার বাড়ছে বলে জানান তিনি। বিভিন্ন সমীক্ষায় জানা গেছে, বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১ জন লোক আত্মহত্যা করছে। বাংলাদেশে ৫১ সেকেন্ডে একজন লোক আত্মহনন করছে। ২০১২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে বাংলাদেশে ৮ লাখের বেশি লোক আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। সারা দেশে ৪০ লাখ টিনএজ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। তাতে মৃত্যুর পরিণতি বরণ করতে হয়েছে ১ লাখ টিনএজ ছেলেমেয়েকে। ২০১১ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন জার্নালের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মৃত্যু রেজিস্ট্রারে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে ৫ হাজার ১১৪টি অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা নিবন্ধিত হয়েছিল। এর মধ্যে ৯৭০ জনই আত্মহত্যার শিকার। যা ওই দু’বছরের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ১৯ ভাগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৪.৬ ভাগ বয়স্ক মানুষ হতাশাজনিত পরিকল্পিত আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আরও ১ ভাগ শিশু রয়েছে একই ঝুঁকির মধ্যে। সব মিলিয়ে এদেশে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। হতাশা বা বিষণ্নতার একটা পর্যায়ে তারা আত্মহত্যার ইচ্ছা পোষণ করে। এরপর আত্মহত্যার পরিকল্পনা করে বসে। এবং শেষে আত্মহত্যার উপায় খুঁজতে থাকে। একপর্যায়ে বিষপান বা গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে বসে। এর মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি হয়। টিনএজ এবং তরুণীরাই এই ঝুঁকিতে বেশি রয়েছে। তারা মান-অভিমান, রাগ-ক্ষোভ, ইভটিজিং, প্রেম, বিরহ এবং জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষমতার ঘাটতির জন্যই বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ। এমন পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পিতামাতা ও স্বজনরা তাদের মানসিক সমস্যা বুঝতে পারে না। অনেকক্ষেত্রে বিষণ্নতায় ভোগা নারীকেই এজন্য দায়ী করা হয়। তাদের প্রয়োজনীয় সাপোর্ট, কাউন্সেলিং বা মানসিক চিকিৎসা দেয়া হয় না। একপর্যায়ে তাদের মানসিক আত্মরক্ষাব্যূহ ভেঙে গেলে আত্মহত্যার পরিণতিকেই বেছে নেয়। এছাড়া এখন নারীদের ব্ল্যাকমেইল করে তাদের আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছেড়ে দেয়ার কারণেও ঘটছে আত্মহত্যার ঘটনা। সাইবার ক্রাইমের কারণে প্রতি মাসেই একাধিক আত্মহত্যার ঘটনা সবার দৃষ্টি কাড়ছে। নিঃসঙ্গতা, প্রতিহিংসা, প্রতারণার শিকার ও ন্যায্য অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে বয়স্ক নারী ও পুরুষ। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে যৌতুক প্রথা ও অবৈধ মাতৃত্বের শিকার হয়ে আত্মহত্যার হার এখনও যথেষ্ট। শুধু তাই নয়, মানসিক রোগী এবং মাদকাসক্তরাও আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। মাদকাসক্তদের প্রায় ১০ ভাগ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.