আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু-সংক্রান্ত একটি আইন রয়েছে দেশে। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন নামের এই আইনটি জাজ্বল্যমান থাকার পরও এর কোনো প্রয়োগ নেই। কথিত ক্রসফায়ারে কারও মৃত্যু ঘটলে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে শুধু বলা হয় সেটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। কিন্তু এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডটির বিচার যে বিদ্যমান আইনেই সম্পন্ন করা সম্ভব বা উচিত, সে কথা স্পষ্টভাবে সাধারণত বলতে শোনা যায় না। বিদ্যমান আইনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, ধৃত ব্যক্তিকে নির্যাতনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অন্যূন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং নির্যাতনের সময় কেউ মৃত্যুবরণ করলে নির্যাতনকারী অন্যূন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আইনে এমনও বলা আছে, হেফাজতে কারও মৃত্যু হলে নিরাপত্তা বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ বা অন্য কোনো অজুহাত দেখিয়ে কেউ পার পাবে না। সবচেয়ে বড় কথা, আইনটির ৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির বিবৃতি লিপিবদ্ধের পর আদালত তা পুলিশ সুপারের কাছে পাঠাবেন ও মামলা দায়েরের আদেশ দেবেন এবং সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যদি মনে করেন, পুলিশের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে আবেদন করলে আদালত সন্তুষ্টিসাপেক্ষে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিতে পারবেন। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনটি প্রয়োগের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমাও নেই, অর্থাৎ সংক্ষুব্ধরা ২০ বছর পরও এই আইনের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থী হতে পারবেন।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, হেফাজতে সন্দেহভাজন বা প্রকৃত দোষীকে নির্যাতন ও তার মৃত্যু ঠেকানোর জন্য বর্তমান সরকারের সদিচ্ছার কোনো অভাব ছিল না, কারণ আইনটি প্রণীত হয়েছে এই সরকারের আমলেই। কী কারণে এই আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়। অনেকে আইনটিকে ঘুমন্ত বাঘের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এ পর্যন্ত হেফাজতে মৃত্যুর অসংখ্য ঘটনা ঘটলেও অতি অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রেই মামলা হয়েছে। এর একটি বড় কারণ হল, যাদের হেফাজতে ধৃত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে, তারা অর্থাৎ পুলিশ মামলা নিতে চায় না। আবার পুলিশের কাছে গিয়ে ব্যর্থ হলে আদালতে যাওয়ার যে সুযোগ রয়েছে, সংক্ষুব্ধদের অনেকেই তা জানেন না। সেক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ বিশেষত মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে আদালতের সাহায্য চাওয়া যেতে পারে বৈকি। তৃতীয় পক্ষ থেকে মামলা করার ধারাটিও সংযুক্ত রয়েছে আইনে।
এ পর্যন্ত আইনশৃংখলা বাহিনীর হেফাজতে যত মৃত্যু ঘটেছে, সেগুলোর কোনো কোনোটি হয়তো ক্রসফায়ারই বটে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশের ক্রসফায়ার তত্ত্ব মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। আলোচ্য আইনে এতদসংক্রান্ত সব অপরাধই যেহেতু বিচারার্থে গ্রহণীয়, অ-আপসযোগ্য ও জামিনঅযোগ্য, তাই আইনটির যথাযথ প্রয়োগ হলে হেফাজতে নির্যাতনকারী ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ সমঝে চলতে বাধ্য হবেন। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইনটির ব্যাপারে ইতিমধ্যেই সরকারের কাছে আপত্তি জানিয়ে এর সংশোধন দাবি করা হয়েছে। কারণটি বোধগম্য। আমরা মনে করি, এ ধরনের আবেদন প্রত্যাখ্যানযোগ্য। পুলিশকে নির্বিচার হত্যার লাইসেন্স দেয়া যায় না। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা চলে; কিন্তু কোনোভাবেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থনযোগ্য নয়। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার প্রয়োজন রয়েছে বৈকি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.