মহররম শুরু; শোকে মুহ্যমান সারা ইরান। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে মহররম মানেই শোকের মাস। পুরো মাসজুড়ে চলতে থাকে শোক পালনের সংস্কৃতি। প্রায় সবার পরনে কালো কাপড়, মসজিদে মসজিদে, যেখানে সেখানে মর্সিয়া গাওয়া। এ মাসেই নবী বংশ বা পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, বেহেস্তে যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হোসেন কারবালার ময়দানে শহীদ হন। সেই মর্মান্তিক ঘটনাকে স্মরণে রেখে চলে শোক পালন, মনে হয় সারা ইরান শোকে মুহ্যমান। শিয়া মাজহাবে ইমাম হোসেন হলেন তৃতীয় ইমাম। তিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় নাতি। মহররম মাসের ১০ তারিখে তিনি ও তার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য কারবালার ময়দানে ঘাতক ইয়াজিদের বাহিনীর হাতে অত্যন্ত হৃদয়বিদারকভাবে শহীদ হন। ইমাম হোসেনের শাহাদাত এবং তার আগে-পরের ঘটনাবলীকে স্মরণ করে মহররম মাসে ইরান রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করে। এ সময় বিভিন্ন জায়গায় কালো পতাকা দেখা যায়। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, রাস্তাঘাট, পাড়া-মহল্লা, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব জায়গায় শোকের চিহ্ন কালো পতাকা ওড়ানো হয়। মহররম মাস আসার আগেই ইরানে শুরু হয়ে যায় শোক পালনের প্রস্তুতি। মসজিদগুলোর পাশাপাশি রাস্তাঘাট, পাড়া-মহল্লা যেখানে সেখানে অস্থায়ী হোসাইনিয়া বানানো হয়। এসব কাজে যেমন থাকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা তেমনি থাকে ব্যক্তি ও সামাজিক উদ্যোগ। মহররম পালনের যেসব কার্যক্রম চলে তার অগ্রভাগে থাকে ইরানের তরুণ-কিশোরেরা। কালো কাপড়ে ঘেরা হোসাইনিয়া বানানো হয়ে যায় মহররম মাস শুরুর আগেই। এছাড়া, হোসাইনিয়াগুলোতে উড়তে থাকে লাল ও সবুজ পতাকা। তাতে লেখা থাকে ইমাম হোসেন, হাসান, কিংবা ইমাম আলীর নাম। যেসব কাপড় দিয়ে হোসাইনিয়াগুলো ঘেরা হয় তাতে লেখা থাকে নবী বংশের সদস্যদের নাম, কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা নিয়ে ছোট ছোট বর্ণনা ইত্যাদি। সাধারণত সন্ধ্যার পর থেকে এসব হোসাইনিয়াতে লোকসমাগম হয়। সাউন্ডবক্সে বাজতে থাকে কারবালার বেদনাবিধুর ঘটনাবলীর বর্ণনা। সেখানে সবার জন্য বিনামূল্যে চা, কফি, চকোলেট, খোরমা, কিউবিক চিনি থাকে। যে যার মতো করে খেতে পারে। চলতি পথে পথিকজনও খেয়ে যেতে পারে এসব খাবার। কখনো কখনো শরবত, কেক, বিস্কুট কিংবা মিষ্টি বিতরণ করা হয়। অনেকে স্বেচ্ছায় এসব চা-শরবত, খোরমা ও বিস্কুটের খরচ যোগান দেন। মহল্লার হোসাইনিয়াগুলোতে সন্ধ্যার দিকে দেখা যায় শিশু, ছেলেমেয়েদের ভিড়। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত একটু বাড়লেই চলে তাজিয়া মিছিল বের করার প্রস্তুতি। এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লায় যায় সে মিছিল; এ মিছিলে অংশ নেয় শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সের লোকজন। মিছিল দুই সারিতে এগিয়ে যায় আর দু’পাশ দিয়ে হেঁটে চলে তরুণী ও নারীরা। মিছিলে থাকে কারবালার শোকগাঁথা গাওয়ার আয়োজন। এর সঙ্গে চলে ড্রামের ধ্বনি। মিছিলে অংশ নেয়া ছেলে-বুড়োরা ধীরে ধীরে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে এগিয়ে যায়। অনেকের কাছে থাকে হাল্কা ধরনের শিকলের গুচ্ছ। সে শিকলগুচ্ছ দিয়ে কাঁধের দু’পাশে ও পিঠে মৃদু আঘাত করে। তবে এসব মিছিলে অংশ নেয়া লোকজনের কেউই বুক-পিঠ রক্তাক্ত করে না। এ ধরনের কাজকে ইরানের আলেমরা অন্যায় বলে মনে করেন। ইরানে মহররমের শোক পালন করতে গিয়ে বুক-পিঠ রক্তাক্ত করাকে নিষিদ্ধ বলে বিবেচনা করা হয়। এ বিষয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পক্ষ থেকে পরিষ্কার বক্তব্যও রয়েছে। যাহোক, অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে যায় মিছিল। এ মিছিলে বিদেশি লোকজনও অংশ নিতে পারে; বাধা নেই কারো জন্য। মিছিলে অংশ নেয়া লোকজন সবার পরনে থাকে কালো শার্ট-প্যান্ট। এখানে শোক প্রকাশের জন্য কালোব্যাজ ধারণের সংস্কৃতি নেই। শোক প্রকাশ মানেই কালো পতাকা আর গায়ে কালো জামা। মহররমের তাজিয়া মিছিল শেষে সাধারণত খাবার-দাবারের আয়োজন থাকে। খাবারের আইটেম হিসেবে ভাতের সঙ্গে থাকে ইরানের বিখ্যাত কোরমে সবজি, কেইমে, জেরেস্ক পোলো, জুজে কিংবা কুবিদে কাবাব। মহররমের শোক মিছিলে অংশ নেয়া লোকজনের খাবার দাবারের জন্য অনেকেই নিজ খরচে দুম্বা কিংবা গরু জবাই করে থাকে। এ দান নিতান্তই নবী পরিবারের সদস্য হযরত ইমাম হোসেনের শহীদ হওয়ার স্মরণে; এ দান কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার স্মরণে। এভাবেই যুগ যুগ ধরে ইরানে চলে আসছে মহররমের শোক পালনের রেওয়াজ; কারবালার শোক মুছে যায়নি ইরানি জাতির মন থেকে। কারবালা বেঁচে আছে তাদের হৃদয়ে। শোক পালনের ধরন দেখলে মনে হবে, এই তো বুঝি সদ্যই ঘটে গেছে কারবালার ট্র্যাজেডি!
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.