মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক দেশটির রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন, নিপীড়ন, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া ও গুলি করে হত্যার ঘটনা মর্মন্তুদ। এ ঘটনা এমন এক সময় সংঘটিত হচ্ছে, যখন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সাং সুচির দল মিয়ানমারের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। বিষয়টি দুঃখজনক। জানা গেছে, জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। গত কয়েক দিনে অন্তত কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু বাংলাদেশের পাহাড়, জঙ্গল ও অনিবন্ধিত ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। আশংকার বিষয় হচ্ছে, ঘটনাটি এখন পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপ না নিলেও নিপীড়ন অব্যাহত থাকলে এ ঘটনাকে পুঁজি করে জঙ্গিরা সেখানে সক্রিয় হতে পারে এবং এর ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। বাংলাদেশে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটলে তা সামাল দেয়ার তাৎক্ষণিক কোনো প্রস্তুতি আমাদের নেই, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান না হলে শুধু বাংলাদেশ নয়-ভারত, চীনসহ অন্য দেশগুলোয়ও ছড়িয়ে পড়তে পারে সংকট। এ প্রেক্ষাপটে ঢাকায় আসন্ন অভিবাসনবিষয়ক জিএফএমডি সম্মেলনে ভারত, চীনসহ আশপাশের দেশগুলোর রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে পৃথক বৈঠক করা উচিত এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এ বার্তা পৌঁছানো দরকার যে, বর্বরতা বন্ধে হস্তক্ষেপ করা না হলে মিয়ানমারে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।
সাম্প্রতিক ঘটনার আগে ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে জাতিগত দাঙ্গার ঘটনায় দু’দফায় কয়েক লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছিল। আলোচনার মাধ্যমে তখন অনেককে ফেরত পাঠানো হলেও অসংখ্য রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়ে গেছে। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কারণে দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় আর্থ-সামাজিক ও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটছে। অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশ গিয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে এবং এর দায়ভার বর্তাচ্ছে বাংলাদেশের ওপর। সরকার অবশ্য রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিয়ানমার সফরের সময় সমস্যাটি যথেষ্ট গুরুত্ব পেলেও এ ব্যাপারে খুব একটা অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। গত তিন দশকে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক কমিশনও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলো মিয়ানমারকে চাপ দিলে এ সমস্যার গ্রহণযোগ্য একটি সমাধানে পৌঁছানো যেতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি। বেশ কিছুদিন হয়ে গেল মিয়ানমার সরকার কর্তৃক জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠিত হওয়ার। সাত সদস্যবিশিষ্ট এই কমিশনের কার্যক্রম চলছে যখন, তখনই নতুন করে শুরু হয়েছে রোহিঙ্গা দমন প্রক্রিয়া। কমিশন এখন কী বলে বা করে সেটাই দেখার বিষয়।
আরাকান তথা রাখাইন অঞ্চলে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলমানরা ঐতিহাসিকভাবেই সেখানকার নাগরিক। তারা অভিবাসী নয়। এ ঐতিহাসিক সত্য মেনে নিয়ে মিয়ানমার সরকারের উচিত, রোহিঙ্গা হত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়ন বন্ধ করে তাদের নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার বিষয়ে যতœবান হওয়া।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.