প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় খাদিজা বেগমকে ‘শায়েস্তা’ করতে চেয়েছিলেন বদরুল আলম। তাই তাঁকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছেন। গতকাল বুধবার সিলেট মহানগর অতিরিক্ত বিচারিক হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে এ কথা বলেছেন বদরুল আলম। গত সোমবার সিলেটের এমসি কলেজে পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পর কলেজের ভেতরেই খাদিজা বেগমের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা করেন বদরুল আলম। বদরুল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা। খাদিজা বেগম এখন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্র গতকাল বুধবার জানায়, বদরুল জবানবন্দিতে বলেছেন, ২০১০ সাল থেকে তাঁর খাদিজার বাড়িতে যাতায়াত ছিল। খাদিজাকে তিনি প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ার পরপরই ওই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নষ্ট হয়। একপর্যায়ে তিনি খাদিজাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কোনো প্রস্তাবেই খাদিজা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা রাজি হননি। তাই বদরুল খাদিজাকে ‘শায়েস্তা’ করতে চেয়েছিলেন। জবানবন্দিতে বদরুল বলেন, ‘পুরো ঘটনা রাগের মাথায় ঘটে গেছে।’
গতকাল বদরুলের জবানবন্দি ১৬৪ ধারায় নথিভুক্ত করেন মহানগর আদালতের অতিরিক্ত বিচারিক হাকিম উম্মে সরাবন তহুরা। বেলা ২টা ৪০ মিনিট থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত তাঁর জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা হয়। জবানবন্দিতে বদরুল জানান, গত সোমবার (খাদিজার ডিগ্রি পাস কোর্স) পরীক্ষা শুরু হওয়ার অনেক আগে সকাল ১০টার দিকে তিনি এমসি কলেজে অবস্থান নেন এবং খাদিজা কলেজের কোন ফটক দিয়ে প্রবেশ করেন, সেদিকে নজর রাখতে শুরু করেন। দুপুর ১২টার দিকে খাদিজা কলেজে প্রবেশ করেন। এরপর খাদিজার সঙ্গে তাঁর কুশল বিনিময় হয় এবং তিনি প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি খাদিজার কাছে উত্থাপন করেন। তাঁদের দুজনের প্রেম যেন ভেঙে না যায়, তা নিয়ে তিনি অনুনয়-বিনয় করেন। কিন্তু খাদিজা সেটি মেনে না নিয়ে তাঁকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর খাদিজা পরীক্ষার হলে প্রবেশ করেন। খাদিজা পরীক্ষার হলে গেলে বদরুল একটি কোমল পানীয় ও পানির বোতল কিনে অফিস পিয়নের মাধ্যমে খাদিজার কাছে পাঠান। কিন্তু খাদিজা সেসব নিতে অস্বীকৃতি জানান।
বদরুল জানান, খাদিজা পানীয় নিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর তিনি নগরের আম্বরখানা এলাকায় গিয়ে মাংস কাটার একটি চাপাতি কেনেন। এরপর এমসি কলেজে ফিরে আসেন। পরীক্ষা শেষে খাদিজা হল থেকে বেরিয়ে এলে তিনি রাগের মাথায় সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছা ও বুদ্ধিতে চাপাতি দিয়ে খাদিজাকে এলোপাতাড়ি মাথা, হাতসহ শরীরের নানা জায়গায় কোপাতে থাকেন। এরপর দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ এসে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। জবানবন্দি গ্রহণ শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের মামলার তদন্ত-তদারকের দায়িত্বে থাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (দক্ষিণ) জেদান আল মুসা বলেন, ‘বদরুল সবকিছু স্বীকার করে নিয়েছেন। এ জন্য দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে আমরা এ মামলার চার্জশিট আগামী ১৫ দিনের মধ্যে দিতে পারব।’ জবানবন্দি গ্রহণের পর বদরুলকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বদরুলের স্বীকারোক্তি, প্রেমের প্রস্তাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে খাদিজাকে কুপিয়েছেন খাদিজার চাচা আবদুল কাইয়ুম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বদরুল ২০১০ সাল তাকি আমরার বাড়িত লজিং আছিল। মাস্টর মানুষ। তাঁরে বহুত আদর-যত্ন করছি। সে জওয়াব দিছে আমার ভাতিঝিরে কুফাইয়া। দুধ-খলা দিয়া আমরা কালা সাপ পুষছি।’ তিনি আরও বলেন, ওই বছরেই বদরুলকে তাঁরা বিদায় করে দেন পাঠদানে অমনোযোগিতার জন্য। খাদিজার সঙ্গে বদরুলের যোগাযোগ ছিল বলে তাঁরা কখনো শোনেননি। খাদিজা মুঠোফোন খুব একটা ব্যবহার করতেন না। তিনি ঘটনার দিন তাঁর চাচা আবদুল কুদ্দুসের সঙ্গে পরীক্ষার হলে গিয়েছিলেন। ওই চাচার সঙ্গেই তাঁর ফেরার কথা ছিল। এমসি কলেজের ভেতরে যখন খাদিজাকে কোপানো হচ্ছিল, তখন তাঁর চাচা ভাইঝিকে আনতে কলেজের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থেকেও তিনি বুঝতে পারেননি, খাদিজার ভাগ্যে কী ঘটেছে। পরে তাঁর (খাদিজার) মুঠোফোন থেকে একজন নারী সিলেটের আউশায় তাঁদের বাড়িতে ফোন করে সবাইকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে বলেন। গতকালও খাদিজা অচেতন অবস্থায় ছিলেন। রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের মেডিসিন অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিভাগের পরামর্শক মির্জা নাজিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘৭২ ঘণ্টা শেষ না হলে কিছুই বলা সম্ভব না। তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন। তবে আমরা এখনো আশাবাদী।’ উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর মতো শারীরিক অবস্থা খাদিজার নেই বলেও তিনি জানান। স্কয়ার হাসপাতাল সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, খাদিজার মাথায় যে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, তাকে ‘ডিকম্প্রেশন ক্রেনিয়েকটমি’ বলা হয়। এই অস্ত্রোপচারের উদ্দেশ্য মস্তিষ্কের ওপর তরলের চাপ কমানো। চাপাতি দিয়ে আঘাত করায় খাদিজার মাথায় প্রচুর রক্ত জমে গিয়েছিল। এই চাপ তাঁর মস্তিষ্ক সহ্য করতে পারেনি। তাই তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। গত মঙ্গলবার অস্ত্রোপচার করে চিকিৎসকেরা প্রথমে ওই রক্ত অপসারণ করেন। তবে অস্ত্রোপচারের পর খাদিজার অবস্থার কোনো উন্নতি হলো কি না, তা এখনই বোঝার কোনো উপায় নেই। খাদিজা এখনো লাইফ সাপোর্টে আছেন। রোগীর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে শুক্রবার লাইফ সাপোর্ট কিছুক্ষণের জন্য প্রত্যাহার করে চিকিৎসকেরা একটি সিটি স্ক্যান করার চেষ্টা করবেন। নিউরোলজি ও নিউরোসার্জারি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একজন স্বাভাবিক মানুষের মস্তিষ্ক কতটা কাজ করছে, তা নির্ণয়ে চিকিৎসকেরা গ্লাসগো কোমা স্কেল নামের একটি নির্ণায়ক ব্যবহার করেন। একজন রোগী চোখ খুলছেন কি না, কারও ডাকে এবং স্পর্শ করলে সাড়া দিচ্ছেন কি না—এই তিনটি বিষয় বিবেচনা করে মস্তিষ্কের সুস্থতা বিচার করা হয়। খাদিজার মস্তিষ্কের স্কোর ৬। কারও স্কোর ৮ হলেই তাঁকে মারাত্মক অসুস্থ ধরা হয়। ৮-এর নিচে স্কোর হলে চিকিৎসকেরা সাধারণত অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি নিতে চান না। কিন্তু খাদিজাকে বাঁচিয়ে রাখতে অস্ত্রোপচার ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প চিকিৎসকদের হাতে ছিল না।
সৌদিপ্রবাসী মাশুক মিয়ার তিন ছেলে, এক মেয়ে। খাদিজার অবস্থান দ্বিতীয়। বড় ভাই চীনে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ছেন। একমাত্র মেয়ের শোকে মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। গতকাল তাঁকেও চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিতে হয় বলে জানান তাঁদের স্বজনেরা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.