ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি এবং ও’কিচেন রেস্টুরেন্টে উদ্ধার অভিযান শুরুর আগেই ভেতর থেকে বের হয়ে যায় পাঁচ জঙ্গি। তার আগে জীবিত থাকা সব জিম্মিকে একত্র করে বক্তৃতা দেন জঙ্গি নিবরাস। বিদেশিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন বলে জানান তিনি। এরপর তাঁদের হাতে নিহত ব্যক্তিদের লাশ দেখিয়ে বলেন, ‘এই যে লাশ দেখছ, একটু পর আমাদেরও লাশ দেখতে পাবা।’
১ জুলাই ওই জঙ্গি হামলার পর ভেতরে আটকে পড়েছিলেন—এমন একজন কর্মচারীর কাছ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ওই কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁর দেখা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
গুলশানের ওই দোতলা ভবনের নিচতলায় ছিল ও’কিচেন রেস্টুরেন্ট আর ওপরের তলায় ছিল হলি আর্টিজান বেকারি। সামনে সবুজ লন। একই মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠানই হলি আর্টিজান নামে পরিচিতি পায়। গ্রাহকদের বড় অংশ ছিল বিদেশি নাগরিক।
ঘটনার বর্ণনা দেওয়া ওই কর্মচারী ছিলেন ও’কিচেনের বাবুর্চির সহকারী। তিনি ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে সেখানে কাজ করতেন। তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকেই খাবার দেওয়া শুরু হয়ে যায়। সাড়ে আটটা বা পৌনে নয়টার দিকে আমার কাছে একটা পাস্তার অর্ডার আসে। বাবুর্চি আমাকে পাস্তার সামগ্রী চিলার (ঠান্ডা রাখার কক্ষ) থেকে নিয়ে আসতে বলে। হঠাৎ হইহল্লার শব্দ শুনি। হাতে প্লেটটা নিয়েই চিলার থেকে বের হই। দেখি, অতিথিরা দৌড়াদৌড়ি করছে। একজনকে দেখি গলায় একটা অস্ত্র ঝোলানো আর হাতে চাপাতি। আমার তো মাথা নষ্ট। পরে পত্রিকায় ছবি দেখে জেনেছি, তার নাম রোহান। ভয়ে আমি চিলারে ঢুকতে যাই। একজন জাপানিও আমার সঙ্গে চিলারে ঢুকে।’ ‘চিলারে ঢোকার পরপরই গুলির শব্দ শুরু হয়। প্রায় ১০ মিনিট গুলির শব্দ পাই। মনে হচ্ছিল, এই মারা গেলাম বুঝি। সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতেছি। জাপানি লোকটি প্রচণ্ড ভয় পায়। আধা ঘণ্টা পরে একেবারে নিস্তব্ধ, কোনো শব্দ নাই। জাপানি বের হতে চায়। কিন্তু আমি ওকে বের হতে দিলাম না।’ বলছিলেন ওই বাবুর্চি-সহকারী।
তিনি বলেন, ‘রাত ১০টা বা সোয়া ১০টার দিকে একজন চিলারের দরজা বাইরে থেকে টান মারে। যখন টান মারছে, তখন মনে হলো আত্মাটা বাইর হয়ে গেল। দরজাতে কোনো ছিটকিনি ছিল না। আমরা ভেতর থেকে টেনে ধরি। দরজা আর খুলতে পারেনি। চিলারের ঠান্ডায় দুজনেরই শরীর, হাত-পা কাঁপা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। ১০-১৫ মিনিট পর একজন (রোহান) কিছু একটা দিয়ে টান মেরে দরজা খুলে ফেলে এবং বের হয়ে আসতে বলে। বের হয়ে দেখি, হলরুম ভর্তি লাশ আর লাশ। আমাকে না মারার জন্য অনুনয় করতে থাকি। রোহান জিজ্ঞেস করে, আমি স্টাফ কি না। জবাব দিলে সামনে একটা টেবিলে গিয়ে বসতে বলে। ও (জঙ্গি রোহান) একদম স্বাভাবিক ছিল।’
হলি আর্টিজানের এই কর্মী বলেন, তিনি লাশ টপকে সামনে এগোনোর পর পেছন থেকে দুটি গুলির শব্দ শুনতে পান। বুঝতে পারেন যে তাঁর সঙ্গে চিলারে থাকা জাপানিকে গুলি করা হয়েছে। রেস্তোরাঁর দরজার সামনে একটি টেবিলে তিন সহকর্মীকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখেন। আরেক টেবিলে আরও ছয়-সাতজনকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখেন। তিনি সহকর্মীদের টেবিলে গিয়ে বসেন। তিনি বলেন, ‘মাথা নিচু করে থেকেই কিছুক্ষণ পর এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছিলাম। দেখি, দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নামছে একজন। পরে ছবি দেখে জেনেছি, তার নাম নিবরাস। সে ও রোহান ইংরেজিতে কথা বলছিল। নিবরাস নামার ১০-১৫ মিনিট পর আরেকজন নামে, সে কালোমতো, বেশি কথা বলে না। কারো চোখে চোখ পড়লেই সালাম দিত। তাকে পাগলমতো মনে হলো। পরে জেনেছি, তার নাম সামেহ মোবাশ্বের।
‘তারা হাঁটাহাঁটি করছিল, কথা বলছিল। রাত ১২টার দিকে নিবরাস এসে আমাদের কাছে ওয়াই-ফাইয়ের পাসওয়ার্ড চায়। আমাদের একজন পাসওয়ার্ড বলল। এরপর সে কাকে যেন ফোন করল। মোবাইল দিয়ে লাশের ছবি তুলেছিল।’ বলছিলেন হলি আর্টিজানের এই কর্মী। তাঁর ভাষ্য, ‘রাত দুইটা-সোয়া দুইটার দিকে নিবরাস জানতে চাইল, বাবুর্চি কে? অন্যরা আমাকে দেখিয়ে দেয়। নিবরাস আমাকে রান্নাঘরে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোরাল আর চিংড়ি মাছ আছে কি না। আছে বলার পর বের করে ভাজতে বলল। আমি ছয় টুকরা কোরাল মাছ বের করলাম। নিবরাস সেগুলোকে ১২ টুকরা করতে বলল। রান্নার সময় নিবরাস ও রোহান পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। মাছ ভাজার পর সবাইকে (জঙ্গিরা ও জীবিত থাকা জিম্মিরা) সাহরি খেয়ে রোজা রাখতে বলল।’
বাবুর্চি-সহকারী বলেন, ‘(২ জুলাই) ভোর ছয়টা-সোয়া ছয়টার দিকে জঙ্গিরা হাসনাত করিমকে ডেকে তার হাতে চাবি দিয়ে বলে, বাইরের দুটি গেটের তালা খুলে দিয়ে আসো। একটা সামনের বাগানের গেট, আরেকটা মেইন গেট। হাসনাত করিম গেট খুলে ফিরে আসে। এরপর জঙ্গিরা হাসনাত করিম ও তার পরিবারকে চলে যেতে বলে। ভাবলাম, আমাদেরও যেতে দেবে, কিন্তু দিল না। হাসনাত করিমেরা চলে যাওয়ার পরপর ওপর তলা থেকে আমাদের আরও দুজন স্টাফকে নিয়ে নিচে নামে আরও দুই জঙ্গি। নিবরাস তাদের একজনকে বলল, বাথরুমে আরও কয়েকজন স্টাফ আছে, ওদের বের করে নিয়ে আসতে। আমাদের সব স্টাফকে হলরুমের মাঝখানে দাঁড় করায়। জঙ্গিরা সবাই আসে। তখন সকাল আনুমানিক সোয়া ৭টা হবে।’
এই রেস্তোরাঁ কর্মী বলেন, ‘হলরুমে দাঁড় করিয়ে আমাদের কোরআনের একটি আয়াত শোনায় নিবরাস। তারপর বলল, “ফরেনাররা ইসলামকে খারাপ বানাইতেছে, এ জন্য এদের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম আমরা। আমরা ইসলামের জন্য যুদ্ধ করছি। এই যে লাশ দেখছ, একটু পর আমাদেরও লাশ দেখতে পাবা। আমাদের যাওয়ার সময় হয়েছে। আমরা চলে যাচ্ছি। তোমাদের সঙ্গে জান্নাতে দেখা হবে।” এরপর পাঁচ জঙ্গি বের হয়ে যায়। বাগান পার হয়ে লেকের দিকের রাস্তার দিকে যাচ্ছিল। তখনই গুলি শুরু হয়। আমরা দৌড়ে দোতলায় চলে যাই।’
ওই কর্মী বলেন, ‘কিছুক্ষণ পরই দুই-তিনজন লোকের পায়ের শব্দ পাই। আমরা চিৎকার করে হেল্প চাই। দেখি দুই-তিনজন আর্মি ঢুকছে। আমাদের বলল, “হ্যান্ডস-আপ।” আমরা হাত ওপরে তুলে বেরিয়ে এলাম। স্টাফ পরিচয় দিলে আমাদের মালিককে ফোন দিয়ে একে একে আমাদের সবার নাম বলে। এরপর আমাদের একেকজনকে একেকজন আর্মি ধরে বের করে।’
এভাবে অবসান ঘটে ১২ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর ও রক্তাক্ত জিম্মি সংকটের। সকাল সাড়ে আটটার দিকে সেনা নেতৃত্বাধীন সমন্বিত অভিযান শুরু হয়। অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ নিহত হয় ছয়জন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.