বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক প্রবাশে অর্ধাহারে অনাহারে থেকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা অায় করে দেশে স্বজনের মুখে হাসি ফোটায়। হাজারো কষ্টে থাকলেও স্বজনদের জন্য সময় মতো টাকা পাঠাতে দেরি হয় না তাদের। এরকম একজন প্রবাসী আবুল হোসেন (ছদ্মনাম) ২১ বছর ধরে প্রবাসে কাজ করছেন। ছোট ভাই-বোনদের শিক্ষা দিক্ষায় বড় করেছেন। তাদের কারণে বিয়েও করেছেন অনেক পরে। অথচ ভাই-বোনেরা এখন তাকে অবহেলা করে। মনের দু:খে আবারো পাড়ি জমিয়েছেন সেই প্রবাসে কাজ করছেন একেবারে নিম্ন মানের। আর বয়সের ভারে শরীরটা যেন আর আগের মত কষ্ঠ সহ্য করতে পারে না।
তিনি জানালেন তার ২১ বছরের প্রবাস জীবনের হৃদয় ভাঙ্গা এক গল্প। এক প্রবাসী ভাইয়ের ফেসবুক থেকে তা হুবহু তুলে ধরা হলো- ”তখন রাত সাড়ে ১১ টা বাজে সিঙ্গাপুর। আমি বাড়িতে ফোন করতে ছিলাম এমন সময় দেখলাম পাশে একজন লোক অনেক ক্ষন ধরে আকাশে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবলাম লোকটার কি হয়েছে যে এভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু ক্ষন পর আবার তাকালাম, লোকটা আগের মতই আছে। ফোনের লাইনটা কেটে লোকটার কাছে গেলাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম দেশী ভাই নাকি? লোকটি বললেন হ্যা। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম ভাই অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম আপনি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। লোকটি বললো এইতো ভাই হিসাব করতেছিলাম এই প্রবাসে জীবনে কি পেলাম আর কি হারালাম আর ২১ বছর প্রবাস জীবনে দুঃখগুলো ভাবতে ছিলাম।
আমি ২১ বছরে কথা শুনে খুব কৌতুহলী হয়ে বললাম ভাই আমাকে বলবেন আপনের দুঃখ গুলো আমার খুব শুনতে ইচ্ছে কর করছে।
লোকটি বললো ভাই ২১ বছরে দুঃখগুলো মাত্র কয়েক মিনিটে শুনে কি করবেন। আমি বললাম ভাই আমি হয়ত পারবনা আপনের দুঃখগুলো তাড়িয়ে দিতে, কিন্ত এমনতো হতে পারে যে আপনের দুঃখগুলো থেকে কিছু শিখতে পারি কারণ আমি ও তো একজন প্রবাসী।
লোকটি বললো তাহলে শুনেন আমরা ছিলাম ৬ ভাইবোন আমি ছিলাম সবার বড়। বাবা ছিলেন কৃষক নিজেগো জমি চাষ করতাম বাবার সাথে আমি কাজ করতাম। বাপ বেটা মিলে সংসারে অভাব দূর করতে পারতাম না। ছোট ভাইবোনেরা পড়ালেখা করত ওদের কাউকে ক্ষেতে খামারে নিতাম না যদি পড়ালেখার ক্ষতি হয়।
এভাবে দিনের পর দিন কষ্ট করতে লাগলাম কিন্তূ কষ্টের দিন শেষ হয় না। একদিন কিছু জায়গা বিক্রি করে পাড়ি দিলাম ইরাক। সেখানে চার বছর ছিলাম তারপর বাড়িতে আসলাম। এর মাঝে সংসারে অভাব কিছুটা দূর হলো ভাইবোনদের পড়ালেখা ভালো চলছিল। কিছুদিন যাবার পর দেখালাম আবার ও পুরানো দুঃখটা বাড়ির চারপাশে ঘুরতাছে। আবার পাড়ি দিলাম সিঙ্গাপুর।
সিঙ্গাপুর এসে মাত্র কয়েক মাস থাকার পর পারমিট বাতিল করে দিল। দেশে গিয়ে পড়লাম মহাবিপদে যা টাকা ছিল সব শেষ। মা বাবা বললেন বিয়ে করতে, আমি বিয়ে করেনি কারণ ভাইবোন গুলো পড়ালেখা শেষ করে চাকরি পাক আবার বোনদের বিয়ে দেওয়া হয় নাই।
কয়েক বছর পর আবার আসলাম সিঙ্গাপুর…এর মাঝে কেটে গেল অনেক বছর। ছুটিতে বাড়ি গেলাম বিয়ে করব বলে কিন্ত বিয়ে করতে গিয়ে পড়লাম অনেক ঝামেলায়। বয়স বেশি আর অশিক্ষিত বলে ভাল বাড়িতে বিয়ে করতে পারলাম না। শেষ কোনো উপায় না পেয়ে গরিবের এক মেয়েকে বিয়ে করলাম তা আবার আমার থেকে অর্ধেক বয়সের। জীবনে খুঁজে পেলাম সুখের ঠিকানা। ভালো কাটছিলো ছুটির দিনগুলো মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে আমি একজন সুখী মানুষ। ছুটি শেষ করে আবার চলে আসলাম সিঙ্গাপুর।
সিঙ্গাপুর এসে কোনো কিছু ভালো লাগত না। রাতে ঘুম আসেনা কাজে মন বসে না। বাড়ি যাওয়ার জন্য মন ছটফট করত। মনে মনে ভাবলাম ভাইবোনদের বিয়ে হয়ছে ভালো চাকরি হয়ছে ভাইদের।
এখন আমার দায়িত্ব শেষ এই ভেবে একেবারে বাড়ি চলে গেলাম। আর এটাই ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল এখন সেই ভুলের মাসুল দিতেছি। কিছু দিন যাওয়ার পর দেখলাম চেনা মানুষ গুলো অচেনা হয়ে গেল। যে মা বাবা ভাই বোনদের জন্য এত কষ্ট করলাম তারা যেন আমাকে চিনে না কারণ আমি কেন একেবারে চলে এলাম দেশে।
আর বুঝতে পারলাম এতদিন ওরা আমাকে ভালোবাসেনি, ভালবাসত আমার টাকাকে। আর মা বাবা আমার কথা শুনতোনা ভাইদের কথা শুনতো কারণ ওরা মা বাবাকে বেশি যত্ন করত। মা আর আমার বৌয়ের সাথে প্রতিদিন লেগে থাকত ঝগড়া। মা বলত আমি বৌয়ের কথা শুনি আর বউ বলতো মার কথা। এদিকে বৌয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না। বৌয়ের যেটা ভালো লাগে আবার আমার সেটা ভালো লাগে না।
মাঝে মাঝে এত কষ্ট লাগে যাদের জন্য এত কষ্ট করলাম আজ তারা কত সুখে। আর আমি একাই কত কষ্ট আছি। আজ ভ্যাগের কঠিন আঘাতে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে আমার মন। ভ্যাগের কঠিন নিয়মে পরাজিত হয়ে দিক্বিদিক হারিয়ে ফেলেছি।
যে না পাওয়াটার জন্য এত কষ্ট করলাম আজ তা পেয়ে হারালাম। অভাবে দিন যে কত বড় তা শুধু অভাবে যারা থাকে তারা বুঝে।
আবার টাকা ঋণ করে সিঙ্গাপুর আসলাম। ঋণের তাড়নায় কোনো কিছু ভালো লাগে না। একদিন ভাইকে ফোন দিয়েছিলাম বললাম আমাকে এক লক্ষ টাকা ধার দে। সে যে কথা বলছে আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না। আমাকে বলল, এক বেলা না খেয়ে থাকলে তাকে খাওয়ানো যায় বা ১শ টাকা ১ হাজার টাকা ধার দেওয়া যায়। কারো ঋণ শোধ করা যায়না।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করত মরে যায় কিন্ত আমার একটি ছেলে আছে তার কি হবে। মা বাবা ভাই বোন সবাই সুখে আছে হয়ত বউ চলে যাবে কিন্ত আমার ছেলের কি হবে। ভাইদের অনাদর অবহেলা বড় হবে। তাই আবার নতুন করে যুদ্ধ শুরু করলাম শেষ বয়সে।
কথাগুলো বলতে বলতে ভাইটি কাঁদছিল। আমি ও তার কথা শুনতে শুনতে কখন যে কাঁদতে ছিলাম আমি নিজে বুঝতে পারি না দেশী ভাই কে কি বলে সান্ত্বনা দেব আমার সব ভাষা হারিয়ে ফেলছিলাম। শুধু বললাম, আমরা প্রবাসীরা হলাম এমন এক যুদ্ধর সৈনিক। যে যুদ্ধর জয়ের উল্লাস আমরা করতে পারি না দিয়ে দিতে হয় অন্যদের…হয়ত অন্যদের মাঝ থেকে জয়ের উল্লাস কেউ পায় আবার কেউ পায় না। অথচ এই যুদ্ধে আমাদের দিতে হয় পরিশ্রম নামে জীবনের স্বাদ ইচ্ছা ভালো লাগার মুহূর্তগুলোকে। প্রবাসী ভাইদের বলবো যতদিন প্রবাসে থাকবেন কিছু টাকা সঞ্চয় করেন।”
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.