ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় হতদরিদ্র মানুষের নামে ১০ টাকা কেজিতে ন্যায্যমূল্যের চাল বিক্রির কার্ড বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আওয়ামী লীগের নেতাদের স্বজনদের পাশাপাশি মৃত ব্যক্তি, শিশু ও বিত্তবানদের নামেও এ কার্ড দেওয়া হয়েছে। বছর চারেক আগে মারা গেছেন রায়পুর ইউনিয়নের শালিকষা গ্রামের খলিলুর রহমান। তাঁর নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কার্ড। খলিলুর জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রুহুল আমিনের বড় ভাই আবদুর রহমানের ছেলে। কার্ডের তালিকায় রুহুল আমিনের দুই স্ত্রীর নামও রয়েছে। রুহুল আমিন রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) দুবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। ঠাকুরগাঁওয়ের কেন্দ্রীয় আখ চাষি সমিতির সভাপতিও ছিলেন দীর্ঘদিন। বর্তমানে তিনি ওই সংগঠনের উপদেষ্টা। রুহুল আমিন বলেন, ‘খলিলুরের নামে কীভাবে কার্ড এল, বলতে পারছি না।’ খলিলুরের স্ত্রী ফেরজা বেগম অবশ্য দাবি করেন, তিনি চাল তুলতে যাননি। কার্ডটি এখন কোথায়? জানতে চাইলে তিনি বলেন, কার্ডটি সামাদের কাছে আছে। সামাদ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। জামালপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পারপূগী গ্রামের ইউনুস আলীর এক ছেলে রিতু (১০) চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। আরেক ছেলে সুয়াদ আলী (৬) স্কুলে যাতায়াত শুরু করেছে। তাদের দুজনের নামেই কার্ড দেওয়া হয়েছে। তবে সুয়াদের বাবার নাম ইউনুস আলী থাকলেও রিতুর বাবার নাম দেখানো হয়েছে মহসিন। তাদের মা বাবলি আকতার বলেন, ‘আমার স্বামীর নাম ইউনুস আলী মহসিন। তালিকায় দুই ছেলের নাম থাকলেও শুধু রিতুর নামে কার্ড দেওয়া হয়েছে। আমাদের আর্থিক অবস্থা দেখে দলের লোকজনই এ কার্ডটি দিয়েছেন।’ ইউনুস আলী ওরফে মহসিনের আরেক ভাই মো. মুকুলের ছেলে মো. মিঠুন (১২) সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ওর নামেও কার্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এ ইউনিয়নে কার্ড পেয়েছেন আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সভাপতি ওষুধ ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলাম, ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সহসভাপতি খতিবর আলী, ব্যবসায়ী মো. লিটন আলীসহ বিত্তশালী অনেকই। মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান। ছেলে সফিউর রহমানের নামে তিনি কার্ড নিয়েছেন। এ ছাড়া তালিকায় রয়েছে মোস্তাফিজুর রহমানের ভাই মাতৃগাঁও গ্রামের রমজান আলী, আনিসুর রহমান, চাচাতো ভাই আফসার আলী, আবদুর গফ্ফার, ভাতিজা মজিরুল ইসলামের নাম। একই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাকডোব গ্রামের বাসিন্দা আবদুল কাদের। তাঁর স্ত্রী মোছা. দিলুয়ারা বেগমকে কার্ড দেওয়া হয়েছে। কাদেরের ভাইদের মধ্যে রবিউল ইসলাম, রেজাউল করিম, হুসেন আলী ও আক্তার আলম ঢাকায় চাকরি করেন। ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিক্রির কার্ড তাঁরাও পেয়েছেন। তবে আবদুল কাদেরের দাবি, তিনি এসব কার্ডের বরাদ্দ তুলে স্থানীয় একটি এতিমখানায় দান করেন। এ ছাড়া ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. সামাদের মেয়ে মোছা. কহিনুর, ছেলে মো. আলমগীর, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মানিক ও তাঁর দুবোন জেসমিন আক্তার ও মোছা. মুক্তার নামও তালিকায় পাওয়া গেছে। ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরত আলী নিজের নামে ও তাঁর ছেলে আবদুর রাজ্জাকের নামেও কার্ড নিয়েছেন। এ ছাড়া তালিকায় মোহাম্মদপুর গ্রামের ফয়জুল রহমান, গিলাবাড়ি গ্রামের মো. ইব্রাহীম, অনেক বিত্তশালী লোকসহ ইউপি সদস্য সোলায়মান ও আবদুল মমিনের স্ত্রীদের নাম পাওয়া গেছে। রুহিয়া ইউপির ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ললিত কুমার রায় পাকাবাড়ি, মিল-চাতাল ও কয়েকটি পাকা দোকানঘরের মালিক। তাঁর ছেলে অর্জুন কুমার রায়ও কার্ড পেয়েছেন। ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাংসদ রমেশ চন্দ্র সেনের গাড়িচালক আবদুল মজিদের ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুনের নামে কার্ড দেওয়া হয়েছে। ঘনিমহেশপুর গ্রামের মৃত সুবানের ছেলে আবদুল গফুর কাতারপ্রবাসী। তালিকায় তাঁরও নাম দেখা গেছে। ইউপি সদস্য হালিমা বেগমের স্বামী জাহাঙ্গীর আলম, ভাশুর খাদেমুল ইসলাম, দেবর জাহেরুল ইসলাম ও দেবরের ছেলে সুলতার আলমের নামে কার্ড রয়েছে। হতদরিদ্র লোকজনের তালিকা বাছাই কমিটির সদর উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের সভাপতি ও সদর উপজেলার সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রতিকুল ইসলাম বলেন, ‘তালিকায় মৃত ব্যক্তির নাম থাকলেও আমার করার কিছুই ছিল না। তালিকায় সই করা ছাড়া তালিকা তৈরিতে ট্যাগ অফিসারদের হাত নেই। চেয়ারম্যান ও ইউপি সচিব তালিকা তৈরি করে যেভাবে আমার কাছে দিয়েছেন, আমাকে সেই তালিকাতেই সই করতে হয়েছে।’ রায়পুর ইউপির চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, তালিকা প্রণয়ন করেছে বাছাই কমিটি। আমি সেই কমিটির একজন সদস্য মাত্র। তবে কিছু অনিয়মের শোনা যাচ্ছে। সেগুলো খতিয়ে দেখে সংশোধনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তালিকা বাছাই কমিটির উপজেলা সভাপতি ও ইউএনও আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘তালিকা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় কথা হচ্ছে বলে শুনতে পেরেছি। তবে কেউ তেমনভাবে অভিযোগ করেননি। তবুও তালিকা যাচাই করে অসংগতি পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.