ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফটকে অ্যাম্বুলেন্স চাপায় দুই নারী, এক শিশুসহ চারজন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে এক নারী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। গতকাল শনিবার সকাল সোয়া নয়টার দিকে ‘মানব সেবা’ নামের অ্যাম্বুলেন্সটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাঁদের চাপা দিলে এ ঘটনা ঘটে। হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী বলেছেন, অ্যাম্বুলেন্সটির (সিলেট মেট্রো-ছ ৭১-০০৬৪) মালিকদের একজন এই হাসপাতালের এক ওয়ার্ড বয় মাহফুজুর রহমান। দুর্ঘটনার সময় অ্যাম্বুলেন্সটি চালাচ্ছিলেন চালকের সহকারী সোহেল মিয়া (১৮)।
এ দুর্ঘটনার পর হাসপাতাল এলাকায় তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। চিকিৎসা নিতে আসা লোকজন বলেন, এখানে যাঁরা অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের কাছে রোগীরা জিম্মি। রোগীদের জিম্মি করে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে যাচ্ছে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা এ ধরনের অ্যাম্বুলেন্স-সেবা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এ দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা হচ্ছেন গোলেনুর বেগম (২৫), তাঁর সাত বছরের ছেলে সাকিব, অন্তঃসত্ত্বা আমেনা বেগম (৩০) ও অজ্ঞাতনামা পুরুষ (৬০)। আহত ব্যক্তিরা হচ্ছেন নিহত গোলেনুরের ছয় মাস বয়সী ছেলে আকাশ, আমেনা বেগমের ছেলে সজীব (৮), বাচ্চু মিয়া (৩৫) ও রমজান আলী (৩০)। নিহত অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি সম্পর্কে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, জরুরি বিভাগের মূল ফটকের পাশে বসে তিনি ভিক্ষা করতেন। তাঁর বয়স আনুমানিক ৬০ বছর।
ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, তখন জরুরি বিভাগের মূল ফটকের সামনে ভিড় ছিল। মূল প্রবেশপথের প্রায় পুরোটাই দখল করে ছিল রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা। এ সময় একটি অ্যাম্বুলেন্স দ্রুতগতিতে ভেতরে ঢুকতে থাকে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এটি প্রবেশমুখের ফটকের একটি অংশে ধাক্কা দেয়। সেখান থেকে সামনে যাওয়ার সময় অন্যদের চাপা দেয়। ফটকের অংশটিও ভেঙে যায় এবং হতাহতের ঘটনা ঘটে। যেখানে এ ঘটনা ঘটেছে, তার পাশেই হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্প। সেখান থেকে পুলিশ দ্রুত এসে চালকসহ অ্যাম্বুলেন্সটি আটক করে।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক বলেন, শুক্রবার রাতে একটি মরদেহ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি ঢাকার বাইরে গিয়েছিল। শনিবার সকালে সেটি ঢাকায় ফেরে। আরেকটি মৃতদেহ নিতে অ্যাম্বুলেন্সের মালিক ওয়ার্ড বয় মাহফুজুর ও মূল চালক সোহাগ তাঁর সহকারী সোহেলকে অ্যাম্বুলেন্সটি নিয়ে হাসপাতালের ভেতরে যেতে বলেন। জরুরি বিভাগের প্রবেশপথ দিয়ে যাওয়ার সময় সামনে একটি রিকশা পড়ে। রিকশা দেখে সোহেল অ্যাম্বুলেন্সের ব্রেকে চাপ দিতে গিয়ে এক্সেলেটরে চাপ দেন। ফলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ওসি বলেন, ‘ও তো এক্সেলেটর আর ব্রেকের পার্থক্য বোঝে না।’ রাত দেড়টার দিকে এ ঘটনায় মাহফুজুর, সোহাগ ও সোহেলের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বলে ওসি জানিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স-সেবার অব্যবস্থাপনা নিয়ে গত ১৭ জুলাই প্রথম আলোর শেষ পাতায় ‘কর্মচারীদের অ্যাম্বুলেন্সের কাছে জিম্মি রোগী’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। তারপরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অভিযোগ আছে, অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার সঙ্গে হাসপাতালের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জড়িত। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে আসা অ্যাম্বুলেন্স, স্কুটার ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করে। এদের ‘ট্যাক্সি ও প্রাইভেট কার মালিক সমিতি’ নামে একটি সমিতি আছে। সমিতিকে নগদ টাকা না দিয়ে এখান থেকে কোনো রোগী বা মৃতদেহ কেউ নিতে পারে না। হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, রোগী ও লাশ পরিবহনের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। এর সুযোগ নিয়ে হাসপাতালের কর্মচারীরা অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা শুরু করেন। কর্মচারীদের ৭০-৭৫টি অ্যাম্বুলেন্স আছে। অ্যাম্বুলেন্সগুলো প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের দেয়াল ঘেঁষে রাখা হয়। কিন্তু গতকাল রাতে হাসপাতালের সামনে গিয়ে কোনো অ্যাম্বুলেন্স দেখা যায়নি।
নাম না প্রকাশের শর্তে হাসপাতালের এক কর্মচারী বলেন, দুর্ঘটনার পর হাসপাতালের সামনে থেকে সব অ্যাম্বুলেন্স সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাই কোনো অ্যাম্বুলেন্স নেই।
জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মুখপাত্র খাজা আবদুল গফুর বলেন, দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত অ্যাম্বুলেন্সটির মালিক হাসপাতালের কেউ, এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। পুলিশকে অ্যাম্বুলেন্সটির চালক, সহকারী ও মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
নিহত সাকিবের চাচা মো. রিয়াজ খলিফা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ফেরদৌস খলিফা পেশায় রিকশাচালক। স্ত্রী-সন্তানসহ পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালিতে থাকেন। গত মঙ্গলবার বাড়ির সামনে খেলার সময় সাকিবকে একটি মোটরসাইকেল ধাক্কা দিলে সে মাথায় আঘাত পায়। চিকিৎসার জন্য শুক্রবার সকালে সাকিবকে সূত্রাপুরে তার মামার বাসায় আনা হয়। সঙ্গে সাকিবের বাবা, মা ও একমাত্র ছোট ভাই আকাশও (বয়স ছয় মাস) আসে। গতকাল সকালে তাঁরা সপরিবার ঢাকার সূত্রাপুর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন। জরুরি বিভাগের প্রবেশমুখে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিচ্ছিলেন ফেরদৌস। আর মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে হেঁটে এগোচ্ছিল সাকিব। হঠাৎ পেছন থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে সাকিবকে চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই মারা যায় সাকিব। ধাক্কায় সাকিবের মা গুরুতর আহত হন, আর মায়ের কোলে থাকা আকাশ মাথায় আঘাত পায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা তিনটার দিকে সাকিবের মা মারা যান। পুরো ঘটনা ফেরদৌসের চোখের সামনেই ঘটে।
ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা আমেনা বেগম ছেলে সজীবকে সঙ্গে নিয়ে ফার্মেসিতে যাচ্ছিলেন চিকিৎসাধীন স্বামীর জন্য টেস্টটিউব কিনতে। জরুরি বিভাগের ফটকের সামনে গেলে একই অ্যাম্বুলেন্স তাদের চাপা দেয়। এতে সজীবের পা ভেঙে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত লাগে। আমেনা পেটে গুরুতর আঘাত পান। দুজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ দুর্ঘটনায় আমেনার পেটের সন্তানটি মারা যায়। দুপুরে অস্ত্রোপচার করে মৃত সন্তানকে বের করে আনেন চিকিৎসক। সন্ধ্যায় আমেনাও মারা যান। ছেলে সজীব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
গত ২৬ আগস্ট ট্রাক দুর্ঘটনায় আমেনার ট্রাকচালক স্বামী জাকির হোসেনের পা ভেঙে গেছে। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার আলীগঞ্জের এই বাসিন্দা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর যখন আট মাস বয়স, তখন তাঁর মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়। স্ত্রী-সন্তান ছাড়া তাঁর আপন কেউ নেই। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমার জীবনের আর কোনো মূল্য থাকল না। কার জন্য আর বাঁচব আমি।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.