পিতার চোখের সামনেই ট্রেনের নিচে চলে গেল পারভেজ। ট্রেন আসতে দেখে অদূরে বাসা থেকে ছেলেকে অনেক ডাকাডাকি করে বলেছিলেন কিনারে দাঁড়িয়ে থাকতে। বাবার সেই হাকডাক কাজে আসেনি। মুহূর্তেই দানবরূপে ছুটে আসা ট্রেন তার নিচে পিষ্ট করে। নির্মাণ শ্রমিক আনিস মিয়ার একমাত্র ছেলে পারভেজ। ব্র্যাক স্কুলে ফাইভে পড়ে সে। গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মোবাইল ফোনে ট্রেনের ছবি তুলতে গিয়ে পারভেজসহ ৩ কিশোরের মৃত্যু হয়। গতকাল বাদ আছর ও মাগরিবের নামাজের পর তাদের জানাজা শেষে দাফন করা হয়। এদিকে ৩ কিশোরের মৃত্যুতে এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। গতকাল বিকালে শহরের ভাদুঘর এলাকায় দুর্ঘটনায় নিহত পারভেজ ও মোনায়েমের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে মানুষের ভিড়। দলবেঁধে আসছে মানুষ। গতকাল সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ভাদুঘর এলাকায় ট্রেনের ছবি তুলার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রেনে কাটা পড়ে ৩ কিশোর। এতে ঘটনাস্থলে বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের কাউছার মিয়ার ছেলে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র মো. শুভ (১০), পৌর শহরের ভাদুঘর ভূঁইয়াপাড়া এলাকার আনিস মিয়ার ছেলে পারভেজ মিয়া (১৪) মারা যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যায় ভাদুঘর কারি বাড়ির বাহার মিয়ার ছেলে স্থানীয় দারুল উলুম ভাদুঘর মাদরাসার নূরানী বিভাগের ছাত্র পৃষ্ঠা ২ কলাম ১ মো. মোনায়েম হোসেন (১২)। ঘটনার সময় মোনায়েমের সঙ্গে তার এক আত্মীয়ও ছিল। পাশে লাফিয়ে পড়ায় সে বেঁচে যায়। নিহত পারভেজ আর শুভ আপন খালোতো ভাই। শুভর বাবা কাউছার মিয়া প্রবাস থেকে দেশে আসার পর গত শুক্রবার শ্বশুর (মঙ্গল ভূঁইয়া) বাড়িতে সপরিবারে বেড়াতে আসেন। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকালে পৌর শহরের ভাদুঘরের ভূঁইয়া বাড়ির পাশে রেলক্রসিং এলাকায় রেললাইনের ওপর বসে শুভ, পারভেজ ও মোনায়েম একে অপরের সঙ্গে কথা বলছিল। ওই সময় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী সোনার বাংলা ট্রেন আসে দেখে রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে ওই তিন কিশোর মিলে মুঠোফোনের ক্যামেরা দিয়ে চলন্ত ট্রেনের ছবি তুলা শুরু করেন। এ সময় বিপরীত দিক দিয়ে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী সুরমা মেইল ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই শুভ ও পারভেজ মারা যায়। একই সময় ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মোনায়েম গুরুতর আহত হয়। পরে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়। ঢাকা নেয়ার পথে নরসিংদী এলাকায় যাওয়ার পর মোনায়েম মারা যায়। একজন প্রত্যক্ষদর্শী কাউসার জানান-তারা ছিল ৪ জন। এর মধ্যে পারভেজ সোনার বাংলা ট্রেনটির ছবি তুলছিল। ঐসময় পেছন থেকে আরেকটি ট্রেন আসছে দেখে আমরা তাদেরকে ঢিল মারতে থাকি রেললাইন থেকে সরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এতে কাজ না হওয়ায় আমরা দৌড়ে ওদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। গাড়িটিও হর্ন দিয়েছিল ২ বার। কিন্তু এর মধ্যেই ট্রেনটি তাদের ওপর দিয়ে চলে যায়। একজন একপাশে লাফিয়ে পড়ে। বাকি ৩ জন ট্রেনের ধাক্কায় এদিকে ওদিকে গিয়ে পড়ে। পারভেজের পিতা আনিস মিয়া জানান- গতকাল তিনি তার ছেলে পারভেজ ও ভায়েরা ভাইয়ের ছেলে শুভকে নিয়ে ফজরের নামাজ পড়েন। এরপর বাসায় ফিরে আসে তাদেরকে কিছুক্ষণ পরে মক্তবে পাঠান। সকাল সাড়ে ৭টায় মক্তব থেকে বাড়ি ফিরে আসে তারা। আমি আমার লোকজনকে নিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে বের হই। পরে বাসায় আসলে আমার ভায়েরা বলে আপনের ভাগিনা মোবাইল নিয়ে বাইরে গেছে। সঙ্গে পারভেজও গেছে। তারা ছিল ৪ জন। ঘুরতে ঘুরতে রেললাইনের পাশে চলে আসে। আমি বাসা থেকে দেখছি তারা দাঁড়িয়ে সোনার বাংলা ট্রেনটি দেখছে। তখন আমি বাসা থেকে ডাক দিয়ে বলি তোরা কিনারে দাঁড়িয়ে থাক। কিন্তু ওইদিক থেকে আরেকটি ট্রেন এসে আমার ছেলেকে ৩ টুকরা করে দেয়। এরপর দৌড়ে গিয়ে দেখি ঠিকই আমার ছেলে পারভেজ ও শুভ মারা গেছে। আনিস মিয়ার বাড়ি সরাইলের আখিতারা গ্রামে। ৭ বছর বয়সে সে ভাদুঘর আসে। পরে এখানে বিয়ে করে সংসারী হয়। শ্বশুর বাড়িতেই থাকতো সে। বাড়ির পশ্চিম পাশেই রেলপথ। মধ্যেখানের খাল পেড়িয়ে রেলপথের দূরত্ব হবে একশো গজ প্রায়। পাশের নাসিরপুর গ্রামে খালার বাড়িতে থাকা নানীকে নিয়ে বাড়িতে আসে মোনায়েম। নানীকে ঘরে রেখে মামাতো ভাই আফ্রিদিকে নিয়ে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। এরপর পারভেজ-শুভর সঙ্গে মিলিত হয় তারা। মোনায়েমের বড় ভাই শিব্বির আহমেদ জানান- তার এক চাচাতো ভাই সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে ফোন করে জানান মোনায়েমের মতো কাপড় পড়া একজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপর আমরা হাসপাতালে ছুটে গিয়ে দেখি মোনায়েমই। এরপর তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। নরসিংদী নিয়ে যাওয়ার পরই মারা যায় সে। ৩ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন মোনায়েম। তার বাবা বাহার মিয়া সৌদি প্রবাসী। মোনায়েমের সঙ্গে থাকা তার মামাতো ভাই আফ্রিদি বেঁচে যায় ভাগ্যক্রমে। ঘটনার পরই সে ভাদুঘর গ্রাম ছেড়ে শহরতলির বিরাশারে নিজ বাড়িতে চলে যায়। তার পিতার নাম নান্নু মিয়া। পরিবারের সদস্যরা জানান- বেঁচে যাওয়া আফ্রিদি ভয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.