বরিশালের বাবুগঞ্জে দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রামে গতকাল বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টকে অভ্যর্থনা জানান এনজেএলআইপির গ্রাম সমিতির সদস্যরা।
গোয়াল ভরা গরু। পুকুর ভরা মাছ। আঙিনায় সবুজ সবজির হাসি। ঘরে ঘরে হাঁস-মুরগির খামার। দারিদ্র্যজয়ের এই সাফল্য রাকুদিয়া গ্রামের সংগ্রামী নারীদের। কিভাবে বদলে গেল রাকুদিয়া গ্রাম? তা নিজের চোখে দেখলেন, নারীদের মুখে শুনলেন, কথা বললেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। দারিদ্র্যজয়ের এই অসামান্য সাফল্যে তিনি মুগ্ধ, অভিভূত।
রাকুদিয়া গ্রাম ঘুরে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বলেন, ‘এই গ্রামের শিশুরা আগে স্কুলে যেত না। হতদরিদ্র নারীদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সামান্য ঋণ দেওয়া হলো। সেই ঋণের টাকায় গরু, হাঁস-মুরগি, মাছ আর সবজি চাষের মাধ্যমে নিজেদের পাল্টে ফেললেন তাঁরা। এ দেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রমী বলেই সম্ভব হয়েছে। তাঁদের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, যা দেখে আমিও অভিভূত।’
গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে বরিশাল বিমানবন্দরে অবতরণ করেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট। সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস, বিভাগীয় কমিশনার মো. গাউস, জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান, পুলিশ সুপার এস এম আক্তারুজ্জামানসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেখানে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান।
বিমানবন্দর থেকে তিনি সকাল ৮টা ৫৮ মিনিটে মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে বাবুগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রামে পৌঁছান। প্রবেশ করেন দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রাম সমিতির কার্যালয়ে। যেখানে খুব সকাল থেকেই অর্ধশতাধিক সংগ্রামী স্বাবলম্বী নারী তাঁর আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন।
শুরুতেই সমিতির কার্যালয়ে তাঁকে স্বাগত জানান সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (এসডিএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম আই চৌধুরী। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান ১৯৮ জন নারীর প্রতিনিধিত্বকারী সমিতির সভাপতি হনুফা বেগম। সকাল ৯টায় সমিতির সদস্যদের সঙ্গে দারিদ্র্যজয়ের গল্প শোনেন বিশ্বব্যাংক প্রধান। বদলে যাওয়ার কথা শোনান সমিতির সদস্য মনি রানী শীল।
মনি রানী শীল দারিদ্র্যজয়ের গল্প শোনাতে গিয়ে বলেন, ‘গ্রামের ৪৭৪টি খানা (ঘর) থেকে ১৮৯ জন নারীর সমন্বয়ে ১৩টি সমিতি গঠন করা হয়েছে। এ সমিতির মাধ্যমে আয়বর্ধনকারী গবাদি পশুপালন, সবজি ও মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালন করে আমরা দারিদ্র্য অনেকটা দূর করতে পেরেছি।’ এ সময় গ্রামের সাফল্যের কথা শুনে উপস্থিত সদস্যদের অভিনন্দন জানান বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম।
বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের কাছে ঋণসহযোগিতা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানিয়ে মনি রানী শীল আরো বলেন, ‘দেশের প্রতিটি গ্রামে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী আর থাকবে না।’ এর আগে প্রকল্পের সার্বিক বিষয়গুলো বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সামনে উপস্থাপন করেন এসডিএফ এমডি এম আই চৌধুরী।
সকাল ৯টা ২০ মিনিটে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় পরিচালিত এসডিএফের নতুন জীবন লাইভলিহুড ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট দেখতে যান বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট। এ সময় তিনি গ্রামের ফরাজী বাড়ির পুকুরে দলীয়ভাবে রুই মাছের মিশ্র চাষ প্রকল্প দেখেন। নারীরা তাঁদের চাষ করা মাছ জাল টেনে দেখান বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টকে। পুকুরের পারেই অবস্থিত কহিনুর বেগমের গাভীর মিনি ফার্মও পরিদর্শন করেন তিনি। এ সময় তিনি শিউলি বেগম, কহিনুর বেগম ও সোনিয়া বেগমের সঙ্গে কথা বলেন।
সকাল ৯টা ৪২ মিনিটে এসডিএফ কার্যালয়ের সামনে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম প্রেসব্রিফিং করেন। নারীদের সাফল্যে সন্তোষ প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘এখানে এসে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। এখানে দরিদ্র মহিলাদের জীবনমান পরিবর্তন হয়েছে। তাঁদের দারিদ্র্য মোচন হয়েছে। আপনারা হয়তো জানেন, বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থায়ন পাওয়া গরিব মহিলারা আগে প্রশিক্ষণ পাননি। অতি দরিদ্র ও দরিদ্র শ্রেণির নারীরা প্রশিক্ষণ পেয়ে গরু পালন ও মাছের চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।’
পেছনের কথা টেনে জিম ইয়ং কিম আরো বলেন, ‘আমরা দেখেছি, এই প্রকল্প চালুর আগে তাঁদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেত না। প্রকল্প চালুর পরে আমরা দেখতে পাচ্ছি তাঁদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। তাঁদের আয় ভালো হচ্ছে। আমরা যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছি তা খুব ভালো দিকে যাচ্ছে।’
বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, ‘আমরা জানি বাংলাদেশের মানুষ খুবই পরিশ্রমী। খুবই কাজ করতে জানে। এরা সহজে পিছিয়ে পড়ে না। তাদের এ অবস্থা দেখে আমরা এ প্রকল্পে আরো অধিক অর্থায়ন করব। আমি অত্যন্ত খুশি—যেসব উপকারভোগী নারীর সঙ্গে কথা বলেছি তাঁদের অবস্থা খুবই ভালো। এ প্রকল্পের সঙ্গে যাঁরা জড়িত রয়েছেন তাঁদের আরো উন্নতি দেখতে চাই, তাঁদের আরো উন্নতি হবে বলে আশা রাখছি।’
২ মিনিট ৩৪ সেক্টেন্ডের প্রেস ব্রিফিং শেষে তিনি সকাল ৯টা ৪৪ মিনিটে দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রাম সমিতির কার্যালয় ত্যাগ করেন। ১০টা ৫ মিনিটে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে উজিরপুর উপজেলার ভরসাকাঠি গ্রামের ভরসাকাঠি প্রাইমারি স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টার পরিদর্শন করেন। এ সময় সেখানে তিনি একটি নারিকেলগাছের চারা রোপণ করেন। পাশাপাশি ওই এলাকায় সৌরবিদ্যুতের সুফলভোগী মমতাজ বেগমের বাড়ি পরিদর্শন করেন। সোলার প্যানেল সিস্টেম পরিদর্শন শেষে সকাল ১১টায় ওই গ্রাম ত্যাগ করেন তিনি। সড়কপথে তিনি বরিশাল বিমানবন্দরে পৌঁছান। ১১টা ৪০ মিনিটে তিনি ঢাকার উদ্দেশে বরিশাল বিমানবন্দর ত্যাগ করেন।
রাকুদিয়া গ্রামের স্বাবলম্বী শিউলী বেগম ও কহিনুর বেগম বলেন, ‘প্রশিক্ষণ নেওয়ার আগে ও পরের অবস্থা সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জানতে চান। আমরা বলেছি, ঋণের মাধ্যমে গাভীর ফার্ম, মাছ চাষ ও বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ করেছি। এতে একদিকে আমরা স্বাবলম্বী হচ্ছি, অন্যদিকে আমাদের খাবারের চাহিদাও মেটাতে পারছি। আগামীতে এই প্রকল্পের মাধ্যমে উপকারভোগীদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেছি। তিনি স্বচক্ষে পুকুরের মাছ দেখে খুশি হয়েছেন। একটি গাভী থেকে কহিনুর বেগম তিনটি গাভীর মালিক হয়েছেন তাও শুনে তিনি অভিভূত হয়েছেন।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.