ফর্সা, লম্বা। কথা বলে শুদ্ধ বাংলায়। দেখতে সুদর্শন, শিক্ষিত মনে হলেও এই যুবকটি দুর্ধর্ষ কিলার। তার টার্গেট মধ্যবয়সী নারী। যার নিজের ভাড়া দেয়ার মতো বাড়ি রয়েছে। বাসা ভাড়া নেয়ার অজুহাতে যমদূত হয়ে হাজির হয় সে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই কিলিং মিশন সম্পন্ন করে। একের পর এক নারীকে হত্যা ও হত্যা করার উদ্দেশ্যে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে এই সিরিয়াল কিলার।
সিরিয়াল কিলার আতঙ্ক এখন ঢাকায়। হন্য হয়ে তাকে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সংগ্রহ করা ৩০টি ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এরমধ্যে দুটি ফুটেজে দেখা গেছে এই কিলারকে। এই ফুটেজগুলো নিয়েই কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সিরিয়াল কিলারের প্রতিটি হামলার ঘটনাই ঘটেছে ঢাকা মেট্রোপলিটনের দক্ষিণখান থানা এলাকায়। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪টি। দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ রোকনুজ্জামান জানান, কিলার যুবকটি শিক্ষিত। বাসা ভাড়ার অজুহাতে হত্যাকাণ্ড ঘটালেও সে কখনও ফোনে কথা বলে এসব বাসায় যায়নি। প্রতিটি হত্যাকাণ্ড ও হামলা একই কায়দায় চাপাতি দিয়ে করা হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তার করতে প্রতিদিন থানা পুলিশের নয়টি টিমকে ব্রিফ করা হচ্ছে। মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করার জন্য এলাকায় প্রায় এক সপ্তাহ মাইকিং করা হয়েছে। দুটি ফুটেজে ওই কিলারের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ওই ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি। সর্বশেষ গত ৭ই সেপ্টেম্বর সোহরাব মজুমদারের স্ত্রী ওয়াহিদা আক্তার সীমাকে (৪৪) হত্যা করে এই কিলার। দক্ষিণখানের আশকোনার গাওয়াইর দক্ষিণ পাড়ার ৭১৫ নম্বর বাড়িতে ঘটে এ ঘটনা। ঘটনার দিন বিকাল সাড়ে ৫টায় এক যুবক ওই বাড়ির নিচতলায় দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপে। তার পরনে ছিল কালো-নীল শার্ট, কালো প্যান্ট ও জুতা। কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো। এ সময় ওয়াহিদা আক্তার সীমার মেয়ে শারমিন আক্তার (২২) তৃতীয় তলা থেকে পরিচয় জানতে চাইলে ওই যুবক বলে, ‘বাসা ভাড়ার বিষয়ে কথা বলবো’। শারমিন তখন জানান ব্যাচেলর ভাড়া দেয়া হয় না। যুবকটি তখন বলেছিল, ‘ব্যাচেলর না, ফ্যামেলির জন্য’। তারপর তৃতীয় তলা থেকেই বাড়ির কেচি গেটের চাবি নিচে ফেলে যুবককে তালা খুলে ভেতরে যেতে বলেন শারমিন। যুবকটি উপরে উঠলে আর শারমিনের সঙ্গে দেখা হয়নি। বাসা দেখানোর জন্য তার মা ওয়াহিদা আক্তার সীমা ওই যুবককে ষষ্ঠ তলায় নিয়ে যান। শারমিন জানান, প্রায় ১৫ মিনিট পরে মায়ের খোঁজে ষষ্ঠ তলায় যাই। পূর্ব পাশের ওই ফ্ল্যাটে ঢুকতেই পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায় তার। রক্তে ভেসে গেছে মেজে। মেজেতে তার মায়ের নিথর দেহ। গলায় একাধিক ধারালো অস্ত্রের আঘাত। মায়ের লাশ দেখে চিৎকার করতে করতেই জ্ঞান হারান শারমিন। তারপর আর কিছু মনে নেই। খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে নিহতের লাশ ও একটি লোহার চাপাতি উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, ফ্রেশরুমে রক্তের দাগ পাওয়া গেছে। এমনকি মেজেতেও পানি দেয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ওয়াহিদা আক্তার সীমাকে কুপিয়ে হত্যার পর নিজের শরীরে লেগে থাকা রক্ত পরিষ্কার করেছে কিলার। যাওয়ার পথে জুতায় যাতে রক্ত না লাগে এজন্য সেই পথও পানি দিয়ে পরিষ্কার করেছে। তার আগে ওই দিনই পাশের একটি বাড়িতে একই ধরনের মিশনে গিয়েছিল এই কিলার। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে। ভিডিও ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুসারে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। ওই বাড়িতে কিলারের আসা-যাওয়ার দৃশ্য দ্বিতীয় তলায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজে রয়েছে। ফুটেজে দেখা গেছে, ৩টা ২ মিনিট ২৮ সেকেন্ডে ওই বাড়ির হারুণ অর রশীদ তরুণের মা তৃতীয় তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলার বাসায় ঢোকেন। ওই নারী জানান, এ সময় ওই কিলার নিচ থেকে ডাকছিলো, ‘কেউ আছেন?’ দ্বিতীয় তলা থেকে তরুণের মধ্যবয়সী মা জানতে চান, কেন, কে আপনি। ওই কিলার বলে, ‘আন্টি আমি বাসা ভাড়া নেবো’। ৩টা ৩ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে সাদা-কালো জামা পরা ওই নারী তৃতীয় তলার বাসা থেকে দরজার সামনে বের হন। এ সময় একজন ভিক্ষুক নারী দরজার সামনে দাঁড়ানো ছিলেন। তারপর ৩টা ৩ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডে একটি মোবাইলফোন হাতে নিচে নামেন তিনি। সেখানে কথা হয় কিলারের সঙ্গে। ওই নারী জানান, দেখতে হ্যান্ডসাম। কথা বলছে শুদ্ধ বাংলায়। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন বাসায় কে কে থাকবে। ভদ্ররূপী ওই কিলার জানিয়েছিল, সে ও তার মা থাকবে। ওই নারী তাকে বাড়ির পঞ্চম তলায় নিয়ে যান। দ্বিতীয় তলা দিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি দেখা গেছে ৩টা ৫ মিনিট ১৫ সেকেন্ডে। ওই নারী জানান, ভাড়াটিয়া বাসা ছাড়েননি। বাসায় লোকজন দেখে দরজার সামনে থেমে যায় কিলার। বাসা দেখাতে তাকে ভেতরে নিয়ে যেতে চাইলে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে সে বলেছিলো, ‘আমি আর দেখবো না। যে জন্য আসছি কোনো লাভ হলো না।’ নারী জানতে চান, কি লাভ হলো না? প্রতি উত্তরে বলেছিল, ‘না, কোনো কাজ হলো না।’ ৩টা ১১ মিনিটে দ্বিতীয় তলা থেকে ওই কিলারের নিচে নামার দৃশ্য দেখা গেছে ভিডিও ফুটেজে। এই কায়দায় গত ৩১শে আগস্ট বেলা আড়াইটায় উত্তরার আজমপুরের মুন্সি মার্কেট এলাকার ৮১/৩৯ নম্বর বাড়ির কাজী মজিবুর রহমানের স্ত্রী জেবুন্নিসা চৌধুরীকে হত্যা করা হয়। ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়ার কথা বলে ওই বাসায় ঢুকে কিলার। চতুর্থ তলার ফ্ল্যাট দেখাতে গেলে জেবুন্নিসাকে পেছন থেকে মাথায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি স্কুল ব্যাগ ও লোহার চাপাতি জব্দ করেছে পুলিশ। জেবুন্নিসা জানান, কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে কোপানো হয়। অন্যদের মতো কিলার সম্পর্কে অভিন্ন বর্ণনা দেন তিনিও। তার আগে ২১শে আগস্ট বাসা ভাড়া নেয়ার কথা বলে দক্ষিণখানের পূর্ব মোল্লারটেক তেতুলতলার ইয়াছিন রোডের ইনুছ মিয়ার বাড়িতে যায় কিলার। দুপুর দেড়টায় ইয়াছিন মিয়ার স্ত্রী সুরাইয়া বেগমের রক্তাক্ত লাশ দেখতে পান প্রতিবেশীরা। নিহতের ভাই শাহজাহান মিয়া জানান, সুরাইয়া পরিবারের সঙ্গে বাড়ির দ্বিতীয় তলায় থাকতেন। তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাট খালি ছিল। ওই ফ্ল্যাটেই তার রক্তাক্ত লাশ পাওয়া গেছ। ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। স্বজনদের ধারণা, ভাড়া নিতে আসা কাউকে ওই খালি ফ্ল্যাটটি দেখাতে গেলে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ মনে করছে, দুর্ধর্ষ ওই কিলারই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পুলিশের তথ্যমতে, এই কিলিং মিশনের শুরু গত ২৫শে জুলাই থেকে। ওই দিন আশকোনা মেডিকেল রোডের ২৩৫ নম্বর বাড়িতে মিশন শুরু করে সিরিয়াল কিলার। বাড়ির মালিক সুলতান আহমেদের স্ত্রী মাহিরা বেগমকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে সে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে উদ্ধার করেন পরিবারের সদস্যরা। জানা গেছে, ওই বাড়ির একটি রুম সাবলেট ভাড়া দিতে টু লেট টানান সুলতান আহমেদ। ঘটনার দিন বেলা সাড়ে ১১টায় চতুর্থ তলায় উঠে এক যুবক। বাসা ভাড়ার অজুহাতে ঘরে ঢুকে মাহিরা বেগমের সঙ্গে আলাপ করছিল সে। একপর্যায়ে তার কাছে থাকা ব্যাগ থেকে চাপাতি বের করে মাথায় দুটি ও গলার পেছনে একটি কোপ মেরে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে ওই কিলার। পরবর্তীতে রক্তাক্ত ও অচেতন অবস্থায় মাহিরাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন স্বজনরা। সিরিয়াল কিলারকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ ও র্যাব কাজ করছে। এ বিষয়ে র্যাব-১ এএসপি নাজমুল হক জানান, তাকে গ্রেপ্তার করতে সব ধরনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু এখনও তার পরিচয় ও অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.