বৃহস্পতিবার বিকেল। কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে একটি অফিসে বসে আছি। এরই মধ্যে তিন তলার সিঁড়ি ভেঙে একজন ভদ্রমহিলা এলেন। দেখেই চিনলাম, নিহত সোহাগী জাহান তনুর মা আনোয়ারা বেগম। পুরো অবয়বে শোক ও কষ্টের ছায়া। উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। কিন্তু তাঁকে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না কেমন আছেন? সেটি নিষ্ঠুরতা হতো। কেবল জানতে চাই, আপনার শরীর এখন কেমন? তিনি বললেন, নিয়মিত হৃদ্রোগের ওষুধ খেতে হয়; ডাক্তার দেখাতে হয়। সেদিনও তিনি ডাক্তার দেখাতে সেনানিবাসের কোয়ার্টার থেকে শহরে এসেছেন। সঙ্গে ছোট ছেলে আনোয়ার হোসেন। তনুর বাবা ইয়ার হোসেনও অসুস্থ। সাত মাস আগে সোহাগী জাহান তনু হত্যার ঘটনা দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করলেও এখন প্রায় নীরব। অনেকেই তনুকে ভুলে গেছেন। কিন্তু বুকে শোকের পাথর বেঁধে বেঁচে আছেন তনুর মা-বাবা ও দুই ভাই। কুমিল্লায় যাওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল তনুর মায়ের সঙ্গে দেখা করা। সেনানিবাসের ভেতরে যাওয়ার নানা ঝক্কি। তাই প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক গাজীউল হকই তাঁকে কুমিল্লায় আসার ব্যবস্থা করেন। আনোয়ারা বেগমকে জিজ্ঞেস করি, হত্যার সাত মাস পার হলো। তদন্তকাজ সম্পর্কে সিআইডি কিছু জানিয়েছে কি? তিনি বললেন, ‘জালালউদ্দিন আহমদ (সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা) এসেছিলেন। আমার সঙ্গে কথা হয়নি। তনুর বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে।’ জালাল সাহেব নাকি বলেছেন, ‘সময় নেবে, যেমন তেমন মানুষ না।’ আনোয়ারা যোগ করলেন, ‘জালাল সাহেব বলেছেন, আমরা দেখতেছি। আপনারা আস্থা রাখেন।’ তনুর মায়ের আক্ষেপ, ‘এত কষ্ট করে মেয়েকে মানুষ করলাম। কিন্তু মেয়েটাকে এভাবে মেরে ফেলল। গত সাত মাসে আমি এমন দিন নেই যে মেয়ের কথা মনে করে কাঁদিনি। পাশে বসা ছোট ছেলেকে দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘ওরা যাতে না দেখে এ জন্য আমার রুমে গিয়ে একা একা কান্দি। এই সাত মাস আমার কাছে সাত বছরের মতো লাগছে।’ তিনি বলেন, ‘তনু মারা যাওয়ার পর ওর বাবা স্ট্রোক করেছে। আমার একটাই প্রশ্ন, মেয়েটারে মারল কেন? মেয়েটাকে যদি ওদের এতই খারাপ লাগত, ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইর কইরা দিত। আমি সরকারের কাছে বিচার চাই, দেশবাসীর কাছে বিচার চাই।’ তনুর কথা বলতে গিয়ে মা মাঝেমধ্যেই খেই হারিয়ে ফেলেন। চোখের পানি মোছেন; কিন্তু ভেঙে পড়েন না। মনকে শক্ত রাখেন। জিজ্ঞেস করি, ‘তনু তো ভালো গান গাইত।’ মা বললেন, ‘এমন কোনো বিষয় নাই ও করত না। ও গান গাইত, নাটক করত, নাচেও ফার্স্ট হইত। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে যে স্কুল, সেখানে ওকে পাঁচ বছর বয়সে ভর্তি করিয়েছি। এরপর কোনো অনুষ্ঠান মিস করেনি।’ এরপর তিনি যোগ করেন, ‘ওর বাবা ছোট চাকরি করেন। কত টাকা বেতন পান? তারপরও ওর অনুষ্ঠানের জন্য আমরা ৩০টি শাড়ি কিনে দিয়েছি। মেয়েদের স্কুলে তো ছেলে ছিল না। তাই অনেক সময় ও ছেলে সেজে অভিনয় করেছে। সে জন্য প্যান্ট-শার্ট বানিয়ে দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘ওর বয়স যখন তিন বছর, তখন কোয়ার্টারে আসি। সেই থেকে এমন দিন ছিল না যে ও আমার গলা জড়িয়ে ধরে সব কথা বলত না।’ তনু যখন কলেজে পড়েন, তখন বাবা-মায়ের কষ্ট বুঝতে পেরে টিউশনি করতেন। নিজে টাকা জমাতেন। মা বললেন, ‘তনু নিজের খরচ জোগাতে বাসায় টিউশনি করত। কিন্তু একদিন প্রতিবেশী এক মহিলা এসে বললেন, “সোহাগী, তুমি অনেক ছেলেমেয়ে মানুষ করছ, আমার মেয়েটারে পড়াও।” কিন্তু ও রাজি না হলে তিনি বলেন, “যেদিন তুমি অবসর পাও সেদিন যাইও।”’ সেই থেকে তনুর বাইরে টিউশনি করা। মাত্র ২ মাস ২০ দিন টিউশনি করেছেন। ঘটনার দিন বিকেল চারটার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। মায়ের ধারণা, ওই মহিলাই তনুকে হত্যায় সহযোগিতা করেছেন। তিনি বলেন, ‘সাড়ে ছয়টায় আমার মেয়ে যে টিউশনি থেকে বের হবে, সে কথা ওই মহিলা ফোন দিয়ে জানিয়েছেন। এগুলো বাইর করছে সিআইডি।’ জানতে চাই, ওই মহিলাকে পুলিশ ধরেছে কি না। তনুর মা বলেন, ‘শুনছি তো তাগোরে এক মাস পরে নিয়ে গেছে।’ আনোয়ার যোগ করেন, ‘তনুকে হত্যার পর বড় ভাই নাজমুলের এক বন্ধুকে আটক করেছিল পুলিশ। পরে তারা বলেছে, ওর সঙ্গে দেখা করলে বা কথা বললে ওর সমস্যা হবে। এ কারণে আমরা আর যোগাযোগ করিিন।’ তনুর মা বলেন, ‘আমি আমার মেয়ের হত্যার বিচার চাই।’ জিজ্ঞেস করি, আপনার মেয়ের সঙ্গে কোনো ছেলের বন্ধুত্ব ছিল কি না? তিনি জবাব দেন, ‘আমার মেয়ে বাসায় এসে সারা দিন কে কী কইছে সব বলত। ও বলত, “লেখাপড়া কইরা মানুষ হইয়া লই। প্রতিষ্ঠিত হইয়া লই।”’ তিনি বলেন, ‘তিন মাস আগে ওর বাবা এক ছেলের কথা বলায় ও তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “বাবা, আমি নাইন-টেনে পড়ি না। এক বছর (অনার্স) গেছে, আর তিনটা বছর আপনি ঝামেলা কইরেন না। এরপর আপনি ছেলে দেইখেন।”’ কলেজের কেউ খোঁজখবর নেন কি না জানতে চাইলে তনুর ভাই বলেন, ভিক্টোরিয়া থিয়েটারের সদস্যরা এখনো খোঁজখবর নেন। প্রথম থেকেই ওরা বিচারের দাবিতে মিছিল-মানববন্ধন করেছেন। আনোয়ারা বেগমকে জিজ্ঞেস করি, ঢাকা থেকে কেউ যোগাযোগ করেছেন কি? তিনি বললেন, একজন বড় আইনজীবীর পিএস টেলিফোন করেছিলেন। গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার আগের দিন। এ ছাড়া মহিলা আইনজীবী সমিতির নেত্রীরা এসেছিলেন, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিরাও এসেছিলেন, তাঁরা কথা বলেছেন। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে তাঁদের তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০ মার্চে, দুর্বৃত্তদের হাতে তনু খুন হওয়ার আগের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘ওই দিন ও খুব হাসতে ছিল। আমি রাগ করে বলি, অত হাসছ কেন? অন্যদিন হলে আমার গলা জড়িয়ে ধরত। সেদিন একা একা বলতে থাকে, আজ কেন যেন মায়ের মনটা খারাপ। যাওয়ার সময় বলল, “আপনি আনতে যাইয়েন না।” আমি সন্ধ্যার আজান দেওয়ার পর গেছি। দেখি কারেন্ট নাই। অন্যদিন সাতটায় ফোন দেয়। টিভিতে আটটার খবর যখন হয়, তখন আমি চিৎকার দিয়ে উঠি, রুবেলরে রুবেলরে (আনোয়ারের ডাকনাম), আমার সোহাগী শেষ। এরপর দেবরের মেয়েকে নিয়ে বের হই। কিন্তু রাস্তায় লোকজন ছিল না। আমি কালভার্টের ওপর বসে পড়ি।’ তনুর মা একজন সাধারণ নারী হলেও চারদিকের খোঁজখবর রাখেন। সম্প্রতি সিলেটে যে খাদিজা নামের এক কলেজছাত্রী দুর্বৃত্তের চাপাতিতে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন, সে কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘খাদিজা তো বেঁচে আছে। খাদিজার মতো তনু যদি বঁাইচা থাকত।’ সাত মাসেও তনু হত্যার তদন্তের অগ্রগতি না হওয়ায় হতাশ মা আনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, ‘কত লোক এসে বললেন, বিচার হবে, অপরাধীরা সাজা পাবে। কিন্তু আজও আমরা জানলাম না কেন এবং কে ওকে হত্যা করল। মুরাদনগরের সাংসদ ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। স্থানীয় সাংসদ বাহাউদ্দিন বাহার সেনানিবাসের বাসায় গিয়েছিলেন। তাঁরা আশ্বাস দিয়েছেন। আবার কেউ বলেছেন, “যদি ক্যান্টনমেন্টের বাইরে হতো আমরা মাটি খুঁড়ে হলেও দেখতাম।”’ তিনি যোগ করেন, ‘ঢাকা থেকে সেনাপ্রধান এসেছিলেন। ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করেছেন, “আপনি কী চান?” তিনি বলেছেন, “আমি মেয়ের হত্যার বিচার চাই।” আরও বলেছেন, “কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের জিওসি থাকতে আপনার হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছে তনু।”’ আনোয়ারা বেগম অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘অনেকে ছেলেকে চাকরি দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু মেয়ের হত্যার বিচার থেকে কি আমার চাকরিটা বেশি? আমার ছেলে বেকার বা কানা না। একটা কিছু করে খাইতে পারবে। আমি মেয়ের হত্যার বিচার চাই।’ মেয়েকে ছাড়া আপনার সংসার কীভাবে চলছে? জবাবে তনুর মা বলেন, ‘সংসার তো এলোমেলোই। আমার মেয়েকে মেরে ওরা আমার সংসার ধ্বংস করে দিয়েছে। ডাক্তারের কাছে যেতে ওর বাবার মাসে সাত হাজার টাকা খরচ যায়। আমার চার হাজার টাকার ওষুধ লাগে। ওর দাদার চিকিৎসা করাতে হয়। এরপর খাওয়া খরচ, বাসাভাড়া আছে, কারেন্ট বিল, গ্যাস বিল আছে। কোনোমতে ওষুধের ওপর বেঁচে আছি।’ জানতে চাই, বড় ছেলে কোথায়? আনোয়ার জবাব দেন, ‘ভাই বিএসসি পাস করে এখন এনা গ্রুপে চাকরি করেন ঢাকায়। তনু হত্যার পর একবার এসেছিলেন। সমস্যা হওয়ায় আর আসতে চান না।’ বড় ভাইয়ের লেখাপড়ায়ও তনুর একটি বড় ভূমিকা ছিল। আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘ডিপ্লোমা পাস করার পর অন্যরা বিএসসিতে ভর্তি হলেও আমার বড় ছেলে ভর্তি হতে পারছিল না। তখন তনু এসে একিদন বাবাকে বলল, “বন্ধুরা বিএসসিতে ভর্তি হয়েছে। ভাইকে ভর্তি করে দিচ্ছেন না কেন?” কেবল কথা বলেই দায়িত্ব শেষ করেনি মেয়েটি। ব্যাংকে নিজের সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে বড় ভাইকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল।’ সন্তানহারা একজন মা যে মনের দিক থেকে কত শক্ত থাকতে পারেন, তা আনোয়ারা বেগমকে দেখলে বোঝা যায়। নানা মহলের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে তিনি তনু হত্যার বিচারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন, সমাবেশে কথা বলেছেন। তিনি জানেন সন্তানকে আর ফিরে পাবেন না। কিন্তু তাঁর দুটি চাওয়া—তনুকে যারা খুন করেছে তাদের শাস্তি এবং ভবিষ্যতে যেন কারও সন্তান অপঘাতের শিকার না হয়। কথা বলতে বলতে এক ঘণ্টা পার হলো। ছেলে মাকে তাগাদা দিচ্ছেন, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কিন্তু তখনো আনোয়ারা বেগমের কথা ফুরায় না। যে সন্তানকে তিনি ২০ বছর ধরে বুকে-পিঠে মানুষ করেছেন, যে সন্তানকে ঘিরে ছিল তাঁর আকাশসমান স্বপ্ন, সেই সন্তানের কথা কী করে ফুরাবে? সন্তানের স্মৃতিই এখন তাঁর একমাত্র সম্বল। তুরস্কের বিপ্লবী কবি নাজিম হিকমত লিখেছিলেন, শোকের আয়ু মাত্র এক বছর। কিন্তু মাকে সন্তানের জন্য যে শোক বয়ে বেড়াতে হয়, তার আয়ু আজীবন, আমৃত্যু।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.