পাল্টে যাচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। বদলে যাচ্ছে শ্রমিকদের জীবনমান। জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সবুজ কারখানা বা গ্রিন ফ্যাক্টরি। রফতানি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সৃষ্টি হচ্ছে সবুজ বিপ্লব। পরিবেশবান্ধব এ বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের পোশাক খাত নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা বিদেশী ক্রেতাদের নতুন করে আকৃষ্ট করবে। আর শ্রমিকরা পাবেন আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা। কারখানায় থাকবে সর্বশেষ প্রযুক্তির সব মেশিন, খোলামেলা পরিবেশ; থাকবে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা। এ ধরনের কারখানা নির্মাণ ব্যয়বহুল হলেও তা লাভজনক এবং পোশাক শিল্পের জন্য ইতিবাচক। ফলে দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি শ্রমিকদেরও জীবনমান পাল্টে যাবে বলে ধারণা শিল্প উদ্যোক্তাদের।
বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে জরিপের মাধ্যমে সবুজ শিল্পায়নে বিশ্বের সেরামানের কারখানা (গ্রিন ফ্যাক্টরি) নির্বাচনকারী আমেরিকাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘লিড’ বাংলাদেশের কারখানাগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ‘লিড’ এর পূর্ণ নাম ‘লিডারশিপ ইন অ্যানার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন।’ এরই একটি প্রকল্প প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি)। গ্রিন ফ্যাক্টরির খেতাব পেতে এখন এসব কারখানা ইউএসজিবিসির সঙ্গে শলাপরামর্শ নিয়ে এবং তাদের দেয়া ব্যয়বহুল সব শর্তপূরণ করে এ অসাধ্য সাধনের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন দেশের পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বুকে একটি বিস্ময়কর নাম। তলাবিহীন ঝুঁড়ির সেই বাংলাদেশই আজ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের একটি রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগে বাংলাদেশ একটি আদর্শ নাম। এ দেশের তৈরি পোশাক বিশ্বের দরবারে প্রশংসিত হচ্ছে। প্রায় শতাধিক দেশে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সুনামের সঙ্গে রফতানি হচ্ছে। সেই পোশাক যে কারখানায় তৈরি হয় সে কারখানাও বাংলাদেশে শতভাগ কমপ্লায়েন্ট হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ২৮ কারখানা লিডের গ্রিন ফ্যাক্টরি খেতাব পেয়েছে। এ খেতাব পেতে ১৭০ তৈরি পোশাক কারখানা অপেক্ষমাণ রয়েছে। এটি দেশের অনেক বড় অর্জন, গর্বের বিষয়। এর মাধ্যমে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে এবং তৈরি পোশাকের ব্র্রান্ডিং হবে। সেই সঙ্গে বাড়বে রফতানির পরিমাণও, যার মধ্য দিয়ে আমাদের পোশাক খাতে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের যে রূপকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে, তার লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
গ্রিন ফ্যাক্টরি স্থাপন করতে কিছু নীতিমালা মেনে চলতে হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, যে পরিমাণ জমির ওপর ফ্যাক্টরি হবে তার অর্ধেকটাই ছেড়ে দিতে হবে সবুজায়নের জন্য। ফ্যাক্টরির চারপাশে খোলা জায়গা থাকবে, সবুজ বাগান থাকবে। কারখানা ভবনের সম্মুখে থাকবে লেক-ফোয়ারা। কর্মক্ষেত্রের ভেতরেও থাকবে খোলা জায়গা। শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ থাকবে সুন্দর। এক শ্রমিক থেকে অন্য শ্রমিকের নির্দিষ্ট দূরত্বও থাকবে। এছাড়া সব কাজই অটোমেশনে হবে। মেশিনারিজ হবে অত্যাধুনিক। শ্রমিকদের আবাসন ব্যবস্থাসহ যাতায়াতের জন্য থাকতে হয় বিশেষ সুবিধা। এ ধরনের কারখানায় শ্রমিকদের জন্য লাইফস্টাইল সেন্টার, শিশুদের জন্য দিবাযতœ কেন্দ ও খাবারের জন্য ডাইনিং কক্ষ, মসজিদ অথবা নামাজঘর এবং প্রশিক্ষণ কক্ষ থাকতে হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, লিড সনদ পাওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। শুধু বিনিয়োগ করলেই হয় না, মনিটরিং প্রতিষ্ঠানের নানাবিধ শর্ত মেনে চলাও তার অন্যতম যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়। মোটাদাগে এর জন্য উদ্যোক্তাকে ৮টি শর্ত পরিপালন করতে হয়।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, গ্রিন ফ্যাক্টরির স্বীকৃতি পেতে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করতে হয়। ভবন নির্মাণ শেষ হলে কিংবা পুরনো ভবন সংস্কার করেও আবেদন করা যায়। তবে আবেদনের প্রক্রিয়া যাই হোক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এর জন্য উদ্যোক্তাকে উৎপাদনের শুরু থেকে প্লান্ট গুটিয়ে নেয়া বা ধ্বংস হওয়ার আগ পর্যন্ত কার্যত্রম পরিচালনায় শতভাগ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে হয়।
উদ্যোক্তরা জানান, গ্রিন ফ্যাক্টরি করতে প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন। বিনিয়োগের এ পরিমাণ কারখানার আকার অনুযায়ী সর্বনিন্ম ৩০০ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ দেড় হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
এ পর্যন্ত দেশে যেসব কারখানা গ্রিন ফ্যাক্টরির খেতাব জিতে নিয়েছে, তাদের বেশির ভাগ উদ্যোক্তার বিনিয়োগই ৫০০ কোটি থেকে ১১শ’ কোটি টাকার মধ্যে ছিল। লিড সনদ প্রদানকারী ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের সেরা দশটি গ্রিন ফ্যাক্টরির মধ্যে বাংলাদেশের সাতটি কারখানা স্থান পেয়েছে। ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও ছাড়াও সেরা দশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া বাংলাদেশের সাত তৈরি পোশাক কারখানা হচ্ছে- এনভয় টেক্সটাইল, রেমি হোল্ডিংস, প্লামি ফ্যাশনস, ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও, এসকিউ সেলসিয়াস, জেনেসিস ফ্যাশনস ও জেনেসিস ওয়াশিং, এসকিউ কোলবেন্স ও এসকিউ বিরিকিনা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.