বর্ষায় চারদিকে পানি। শুকনো মৌসুমে মেঠো পথ। কৃষিই ওই এলাকার জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। গ্রামের দরিদ্র পুরুষরা কৃষি আর দিনমজুরের কাজ করেন। মহিলাদের কাজ হলো শুধুই সন্তান জন্মদান আর লালন-পালন। শিক্ষার আলোও তেমন একটা পৌঁছেনি ওই এলাকায়। হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার হাওর এলাকা মানপুর গ্রামবাসীর জীবন জীবিকার চিত্র যুগ যুগ ধরে এমনই। তবে এখন সেখানে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। গ্রামের খায়রুন চম্পারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে নিয়েছেন। নারীরা কাস্তে কোদালের পাশাপাশি হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। ব্র্যাক-এর অতিদরিদ্র কর্মসূচির ফলে এই পরির্তনের ছোঁয়া। ১৭ই অক্টোবর ছিল আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যমুক্ত দিবস। এ উপলক্ষে ব্র্যাক সারা দেশে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি আয়োজন করে। হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাবিনা আলম সরজমিন দেখতে যান এই কর্মসূচির কাজ। বৃহস্পতিকবার তিনি লাখাইর মানপুর জিরুণ্ডা গ্রামে খায়রুন ও চম্পাদের দারিদ্র্য জয়ের গল্প শুনে মুগ্ধ হন। সরজমিন মানপুর গ্রামে গেলে দেখা যায় ঘরে গরে খামার। কেউ গাভী ও ষাঁড় পালন করছেন। আবার কেউ পালন করছেন ভেঁড়া-ছাগল। সাথে রয়েছে হাঁস আর মুরগি। গ্রামের আলাল মিয়ার স্ত্রী চম্পা বেগম। ৩ বছর আগে ব্র্যাকের অতিদরিদ্র কর্মসূচি থেকে একটি ষাড় ও ১০টি হাঁস পান। সঙ্গে সপ্তাহে ২১০ টাকা করে সহায়তা। ৬ মাস ষাঁড়টি লালন পালন করে বিক্রি করেন ২০ হাজার টাকায়। পরে ১৪ হাজার টাকায় ক্রয় করেন একটি ছোট গাভী। এক সময় গাভীটি একটি ষাঁড় বাচ্চার জন্ম দেয়। গাভী থেকে দুধ আর ষাঁড়টি লালন-পালন করে বিক্রি করেন ৩৫ হাজার টাকায়। ওই টাকা দিয়ে তিনি কিছু জমি বন্ধক (ইজারা) নেন। পাশাপাশি হাঁসের ডিম বিক্রি করে ৬ হাজার টাকা দিয়ে স্বামী আলাল মিয়াকে একটি ঠেলাগাড়ি কিনে দেন। এখন স্বামী-স্ত্রী মিলে ভালোই উপার্জন করেন তারা। তাদের তিনটি সন্তানকেই মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ইচ্ছা তাদের। একই গ্রামের খায়রুন এর ৫টি সন্তান। স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেলে ওই সন্তানদেরকে নিয়ে কি করবেন তা নিয়ে বেকায়দায় পড়ে যান। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে যে আয় হয় তা দিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। ৯ মাস আগে ব্র্যাক’র কাছ থেকে গরু ও মোরগ পেয়ে এখন সেগুলো লালন-পালন করছেন। দু’টি মোরগ ও ৯টি বাচ্চা বড় হয়েছে। দু’টি মোরগ বিক্রি করেছেন ৭শ’ টাকা। গ্রামের অন্ধ শাহজাহানের স্ত্রী রুমাও ওই কর্মসূচি থেকে পাওয়া ভেঁড়া লালন-পালন করে এখন এক পাল ভেঁড়০ার মালিক। চম্পা, খায়রুন আর রুমার মতো শ’ শ’ অতি দরিদ্র মহিলা এভাবে উপকৃত হয়ে এখন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। শুধু আয় বর্ধকই নয়। তাদেরকে সাক্ষর-জ্ঞান, বাল্যবিয়ে, বিয়ে রেজিস্ট্রি, যৌতুক, নারী ও শিশু নির্যাতন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, শিশু টিকাসহ ১২টি বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ব্র্যাক’র অতিদরিদ্র কর্মসূচি প্রকল্পের টিম লিডার তানজিনা নূর জিনিয়া জানান, বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বিভিন্ন সময়ে নগদ সহায়তা দিলেও এটি তেমন টেকসই পদ্ধতি নয়। ব্র্যাক-এর অতিদরিদ্র কর্মসূচির মাধ্যমে নির্বাচিত মহিলাকে একটি ষাঁড়/গাভী ও ১০টি মুরগি/হাঁস, একটি গরু ও ২টা ভেঁড়া, ১টি গরু ও ১টা ছাগল, ব্যবসার জন্য দোকান সাজিয়ে দেয়া এবং প্রত্যেককে সপ্তাহে ২১০ টাকা করে দেয়া হয়। দুই বছর এভাবে দেয়ার পর মনিটরিং করা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.