হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল ইস্যুকে মার্কিন রাজনীতির ইতিহাসে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির পর একক বৃহত্তম কেলেঙ্কারি বলে মন্তব্য করে একে ‘ই-মেইলগেট স্ক্যান্ডাল’ নামে আখ্যায়িত করেছেন রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্প। অপরদিকে ক্যাবল নিউজ নেটওয়ার্ক (সিএনএন)-এর রাজনৈতিক ভাষ্যকার স্যালি কোহন বলছেন, যে সব ভোটার হিলারিকে ঘৃণা করছেন তারা মূলত কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে করছেন না (হিলারিকে ঘৃণা করার মতো কোনো তথ্য ভোটারদের হাতে নেই)-এই শ্রেণির ভোটাররা মূলত (নির্বাচনকে ঘিরে হিলারির বিরুদ্ধে চলমান) ‘কন্সপিরেসি থিওরি’র শিকার। এদিকে টাইম ম্যাগাজিনে হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল নিয়ে এফবিআই’র সর্বশেষ মাতামাতিকে ‘নারীর ওপর আক্রমণ’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলের ভাষাতত্ত্বের প্রফেসর রবিন লেকোফ টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তার এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘ই-মেইলগেট ইজ এ বীচ হান্ট। এই অভিযোগ অনেকটা নারীর মধ্যে বেশ্যা খুঁজে ফেরার মতো। কিন্তু, এর টার্গেট শুধু হিলারি ক্লিনটন নন, এর টার্গেট আমেরিকার সকল নারী।’ এ বিষয়ে রিপাবলিকান দলীয় সাবেক ইউএস অ্যাটর্নি জেনারেল আলবার্তো গঞ্জালেস এফবিআই পরিচালক জ্যামস কোমির এই উদ্যোগকে ‘এরর ইন জাজমেন্ট’ বলে মন্তব্য করে তার এ ধরনের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন। রিপাবলিকান দলীয় এই প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল সিএনএন-এর ‘এট দিজ আওয়ার’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে গতকাল বলেন, জেমস কোমির ভূমিকা বিচার বিভাগের দীর্ঘদিনের অনুসৃত প্রটোকলের বরখেলাপ। কারণ, এক্ষেত্রে প্রটোকল হলো তদন্তাধীন কোনো বিষয়ে প্রকাশ্যে না বলা এবং নির্বাচনকালীন কোনো রাজনৈতিক স্পর্শকাতর বিষয় হলে নির্বাচনের পূর্বের ৬০ দিনের মধ্যে তা জনসম্মুখে প্রকাশ না করা।’ আলবার্তো গঞ্জালেস হলেন হিলারির ই-মেইল তদন্তের এই বিতর্কিত উদ্যোগ নেয়ার পর এফবিআই পরিচালক জেমস কোমিকে তিরস্কারকারী তৃতীয় প্রাক্তন ইউএস অ্যাটর্নি জেনারেল। এর আগে ওবামা প্রশাসনের প্রথম মেয়াদের ইউএস অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক হোল্ডার ওয়াশিংটন পোস্টে এবং প্রেসিডেন্ট বুশের দ্বিতীয় মেয়াদের ইউএস অ্যাটর্নি জেনারেল মাইকেল ম্যুকাসে ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত নিজ নিজ মন্তব্য কলামে জেমস কোমির সিদ্ধান্তকে ইনকারেক্ট এবং ফান্ডামেন্টাল প্রিন্সিপালস বহির্ভূত বলে কোমির ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। এদিকে ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের পর গতকাল সিবিএস নিউজ ও এবিসি নিউজ তাদের প্রতিবেদনে নিশ্চিত করেছে যে, মার্কিন কংগ্রেসকে চিঠি লেখার আগে ইউএস অ্যাটর্নি জেনারেল লোরেটা লাইঞ্চের সঙ্গে হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল ইস্যুতে দেখা করেছিলেন এফবিআই পরিচালক জেমস কোমি এবং এ বিষয়ে দুজনের মধ্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা শেষে ইউএস অ্যাটর্নির পরামর্শের বাইরে গিয়ে জেমস কোমি কংগ্রেসকে নিজ দায়িত্বের অংশ হিসেবে লিখিতভাবে বিষয়টি জানান। ই-মেইলগেট কেলেঙ্কারি-মূল কাহিনী: সেক্রেটারি অফ স্টেট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে হিলারি ক্লিনটন অফিসিয়াল ই-মেইলের জন্য মাঝে মাঝে পার্সোনাল সার্ভার ব্যবহার করেছেন, যা ন্যায়সঙ্গত নয়। কেননা এর ফলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শংকা থাকে। কিন্তু, এ বিষয়ে হিলারি ক্লিনটন ইতিপূর্বে সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন মাধ্যমে এবং প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে সুষ্পষ্টভাবে বলেছেন, তিনি এ জন্য দুঃখিত। এমনটি যাতে আর না হয় সে জন্য তিনি এখন অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করবেন। তবে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের হিলারি নিশ্চিত করেছেন যে, এর ফলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কেননা, তিনি কোনো ক্লাসিফাইড ই-মেইল পার্সোনাল সার্ভারের করেননি। তবে যদি এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে এর দায়ভার হিলারি নিজে নেবেন। এভাবে বিষয়টির আপাত সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু, অতি সমপ্রতি হিলারির ঘনিষ্ঠতম সহযোগী হুমা আবেদীনের প্রাক্তন স্বামী, সাবেক ইউএস কংগ্রেসম্যান এন্থনি ওয়েইনারের একটি মামলা তদন্ত করতে গিয়ে এফবিআই কর্মকর্তারা একটি ল্যাপটপে হিলারি ক্লিনটনের বেশকিছু ই-মেইলের সন্ধান পান। ওই ল্যাপটপটি হুমা আবেদীন এবং তার প্রাক্তন স্বামী দুজনেই ব্যবহার করতেন। জানা গেছে, হুমা আবেদীন হিলারি ক্লিনটনের ওই ই-মেইলগুলো ‘ইন্স্যুরেন্স লেটার’ নামের একটি ফোল্ডারে জমা করেন। এ বিষয়ে এফবিআই পরিচালক জেমস কোমি অ্যাটর্নি জেনারেল লোরেটা লাইঞ্চের পরামর্শ নেন। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেলের আপত্তি সত্ত্বেও জেমস কোমি নির্বাচনের আগেই বিষয়টি কংগ্রেসকে লিখিত ভাবে জানান এই বলে যে, খুব সম্ভবত ইতিপূর্বে অনুসন্ধানকৃত হিলারি ক্লিনটনের ই- মেইলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু পাওয়া যেতে পারে যাতে হিলারি ক্লিনটন আইন ভঙ্গ করেছেন বলে প্রমাণ হতে পারে।’ এ বিষয়ে ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়, ওই ফোল্ডারে প্রায় ৫-৬ হাজার ই- মেইল রয়েছে-যার মধ্যে হিলারির ই- মেইল কোনগুলো এবং আসলেই কোনো ই-মেইল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কমেপ্রামাইজ করেছে কিনা-তা নির্বাচনের আগে নির্ধারণ করা দুরূহ। এ জন্যই অ্যাটর্নি জেনারেল লোরেটা লাইঞ্চ বিষয়টি নির্বাচনের আগেই প্রকাশ না করার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু, নির্বাচনের এই অল্প সময় বাকি থাকতে ই-মেইল ইস্যুটি এভাবে জনসম্মুখে নিয়ে এসে এফবিআই পরিচালক তার এখতিয়ার লঙ্ঘন করেছেন কিনা, এখন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আর ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস বিষয়টির তদন্তে সার্বিক সহযোগিতা এবং যতদ্রুত সম্ভব তদন্ত শেষ করে মার্কিন জনগণকে সত্য জানার সুযোগ করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এদিকে গতকাল বিভিন্ন সময়ে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ৩৭০ জন অর্থনীতিবিদ মার্কিন ভোটারদের নিকট লিখিতভাবে আবেদন জানিয়েছেন তারা যেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট না দেন-কারণ, তাদের মতে, ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন অর্থনীতির মূল বিষয়গুলো নিয়ে ভোটারদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন। একই সময়ে ওয়াশিংটন পোস্ট এক প্রতিবেদনে মার্কিন অর্থনীতির গত তিন মাসের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৯ ভাগ-যা এর ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের এক সামপ্রতিক প্রতিবেদন ২ দশমিক ৬ ভাগ হবে বলে ধারণা করেছিলো। বলা হচ্ছে, গত ২ বছরের মধ্যে মার্কিন অর্থনীতি এখন শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এর আগে টাইম ম্যাগাজিন হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল নিয়ে এফবিআইয়ের সর্বশেষ মাতামাতিকে ‘নারীর ওপর আক্রমণ’ বলে মন্তব্য করেছে। টাইম ম্যাগাজিনের অপর একটি গবেষণাধর্মী রিপোর্ট বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ২০ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ জনগণ এখনো মনে করেন দাসপ্রথার বিলুপ্তি ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো। মার্কিন রাজনীতি ও অর্থনীতির এমন প্রেক্ষাপটেই গত সোমবারের রয়টার্স/ইপসোস জরিপে হিলারি ৫ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন, যদিও একদিন আগে এই ব্যবধান ছিল ৬ পয়েন্ট। অপরদিকে ওয়াশিংটন পোস্ট-এবিসি নিউজের জরিপে এই প্রথমবারের মতো ট্রাম্প ১ পয়েন্টে হিলারির চেয়ে এগিয়ে আছেন। ডনাল্ড ট্রাম্পের এই এগিয়ে থাকাকে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইলগেট কেলেঙ্কারির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বলে মনে করলেও এমনটি মনে করছে না বার্তা সংস্থা রয়টার্স এবং সিএনএন। তাদের মতে এমনটি এতো তাড়াতাড়ি বলা যাচ্ছে না। এদিকে জরিপের হাড্ডাহাড্ডি ফলাফল ক্লিনটন শিবিরে প্যানিক তৈরি করেছে বলে কোনো কোনো মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের পর এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্টক মার্কেট আর মুদ্রা বাজার ঝাঁকুনি খেয়েছে। এদিকে ট্রাম্প শিবির স্বাভাবিকভাবেই হিলারির ই-মেইল তদন্তের এই ঘটনাটিকে তাদের মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে নিয়েছেন। ডনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন শহরে নির্বাচনী বক্তৃতায় বলেছেন, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির পর মার্কিন রাজনীতিতে হিলারির ই-মেইলগেট কেলেঙ্কারি হচ্ছে একক বৃহত্তম রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি। তবে হিলারি ক্লিনটন এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন তিনি নিশ্চিত যে, এর আগের অনুসন্ধানে এফবিআই যা পেয়েছে এই ই-মেইলগুলো থেকে তার বেশি কিছু পাবে না। কিন্তু, এই পুনঃতদন্তের টাইমিং নিয়ে হিলারি ক্ষোভ প্রকাশ করে এফবিআইকে পুরো ঘটনা সম্পূর্ণভাবে যতদ্রুত সম্ভব মার্কিন জনগণের সামনে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে ডনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ সম্পর্ক নিয়ে এফবিআই’র হাতে কি কি তথ্য রয়েছে তা দ্রুত জনসম্মুখে প্রকাশ করার আহ্বান জানিয়েছেন হিলারি ক্লিনটন। ই-মেইল ইস্যুকে কন্সপিরেসি মনে করেন কিনা এবং সর্বশেষ জরিপে ট্রাম্পের এগিয়ে থাকাকে কিভাবে দেখছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে গত মঙ্গলবার হিলারি ক্লিনটন সিএনএন-কে বলেন, না, আমি কোনো কন্সপিরেসি থিওরিতে বিশ্বাস করি না। আমি এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন নই, আমরা নির্বাচনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’ বিভিন্ন জরিপে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে হিলারি সিএনএনের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘নির্বাচনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এবং হাড্ডাহাড্ডি লড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক নির্বাচনের ইতিহাসের অংশ।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.