১৯৪২ সালের ৮ই জানুয়ারি। দিনটি ছিল প্রখ্যাত পদার্থবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানি গ্যালিলিও গ্যালিলির ৩০০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ওই একই দিন জন্ম নেন পদার্থবিজ্ঞান ও মহাশূন্যবিজ্ঞানকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া আরেক মহাবিজ্ঞানী। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের পর তাকেই সব থেকে প্রতিভাবান পদার্থবিজ্ঞানী বলে বিবেচনা করা হয়। তিনি আর কেউ নন। স্টিফেন হকিং। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিরহস্য, এর আকার, বিগব্যাং থেকে শুরু করে ব্ল্যাকহোল পর্যন্ত হকিংয়ের গবেষণা মহাশূন্যবিজ্ঞানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। চ্যালেঞ্জে ভরা এক জীবন: হকিংয়ের জন্ম ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে। ফ্রাঙ্ক ও ইসোবেল হকিংয়ের চার সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ তিনি। ছেলেবেলা থেকেই বিজ্ঞান আর মহাশূন্য নিয়ে তার ছিল অদম্য আগ্রহ। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি কলেজে তিনি পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। পরে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কসমলোজি (বিশ্বব্রহ্মান্ডের বিজ্ঞান) নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে ২১ বছর বয়সে পা দেয়ার কয়েক দিন আগে হকিং দুরারোগ্য মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হন। দুই বছরের বেশি তিনি বাঁচবেন বলে আশা ছিল না চিকিৎসকদের। ডক্টরেট সম্পন্ন করতে পারবেন কি না তা নিয়েও সংশয় ছিল। তবে, সব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে তিনি শুধু পিএইচডি অর্জন করেছেন তাই নয়। এখন পর্যন্ত সৃষ্টিজগতের রহস্য সন্ধানে কাজ করে চলেছেন নিরলস। ধীরে ধীরে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেহে। আর হকিং হয়ে পড়েন হুইলচেয়ারে আবদ্ধ। একপর্যায়ে কথা বলা কষ্টকর হয়ে ওঠে তার জন্য। ১৯৮৫ সালে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন পুরোপুরি। এরপর থেকে বিশেষ একটি কম্পিউটারের মাধ্যমে নিজের কণ্ঠ ফিরে পান হকিং। মোটর নিউরণে আক্রান্ত হওয়ার কিছুদিন আগে হকিং পরিচিত হন জেন ওয়াইল্ডের সঙ্গে। ১৯৬৫ সালে এ দুজন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ার আগে এ দম্পতির তিনটি সন্তান হয়। ১৯৯৫ সালে হকিং দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ে করেন। ২০০৬ সালে ফের বিচ্ছেদ হয় তার। গবেষণা: স্নাতক সম্পন্ন হওয়ার পরও ক্যামব্রিজেই কাজ অব্যাহত রাখেন হকিং। প্রথমে রিসার্চ ফেলো ও পরে প্রফেসনাল ফেলো হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৪ সালে রয়্যাল সোসাইটিতে বরণ করে নেয়া হয় হকিংকে। ১৯৭৯ তাকে ক্যামব্রিজের লুকবাসিয়ান প্রফেসর অব ম্যাথমেটিকস নির্বাচিত করা হয়। বিশ্বের সব থেকে সম্মানিত অ্যাকাডেমিক পদ বলে বিবেচনা করা হয়। এই পদে ২য় ব্যক্তি ছিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। হকিং তার ক্যারিয়ারে গবেষণা করেছেন পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক সূত্রগুলো নিয়ে গবেষণা করেছেন যার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয় বিশ্বজগত। হকিং প্রস্তাব করেন, বিশ্বজগৎ যেহেতু শুরু (দ্য বিগ ব্যাং) রয়েছে বলে মনে করা হয়, কাজেই এর শেষও রয়েছে এমন সম্ভাবনাই বেশি। সতীর্থ কসমোলোজিস্ট রজার পেনরোজের সঙ্গে এক গবেষণায় হকিং দেখিয়েছেন যে, অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের থিওরি অব জেনারেল রিলেটিভিটি ইঙ্গিত দেয় যে স্পেস অ্যান্ড টাইমের শুরু বিশ্বজগতের জন্মের সময়। আর তার ইতি ঘটে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে। এর অর্থ হলো আইনস্টাইনের থিওরি ও কোয়ান্টাম থিওরি একীভূত করতে হবে। এই দুই থিওরিকে একসঙ্গে করে হকিং ব্যাখ্যা করেছেন যে, ব্ল্যাকহোলগুলো সম্পূর্ণরূপে নীরব নয়। বরং তারা তেজস্ক্রিয়তা নিঃসরণ করে। এটা ‘হকিং রেডিয়েশন’ নামে আখ্যা পায়। হকিং তার গবেষণা থেকে আরও বলেছেন, যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোন সীমানা নেই। পদার্থবিজ্ঞান আর মহাশূন্যবিজ্ঞানের জটিল সব বিষয়কে খুব সহজে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করার অসামান্য দক্ষতা রয়েছে হকিংয়ের। এজন্য দারুণ জনপ্রিয় লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তিনি। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে সব থেকে সাড়া জাগানো হলো ‘কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ (আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম)। দুরারোগ্য মোটর নিউরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কালের সেরা এই বিজ্ঞানি শারীরিকভাবে হুইল চেয়ারে আবদ্ধ হয়েছেন বটে। কিন্তু তার মন, চিন্তাশক্তিকে আটকাতে পারেনি এই ব্যাধি। চিকিৎসকদের শঙ্কা আর সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে এখনও খুঁজে ফিরছেন বিশ্বজগতের রহস্য। নিজের এই ব্যাধি নিয়ে হকিং বলেছেন, ‘নিজের এই শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে ক্ষুব্ধ হওয়াটা হবে সময়ের অপচয়। জীবনকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমি সেদিক থেকে খুব একটা খারাপ করিনি। আপনার জন্য মানুষের কোনো সময় থাকবে না যদি আপনি সবসময় ক্ষুব্ধ থাকেন বা অভিযোগ করতে থাকেন।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.