যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হঠাৎ করে কেন্দ্রীয় চরিত্রে দুই প্রার্থীর বাইরের একজন। তিনি এফবিআইয়ের প্রধান জেমস কোমি। এক পক্ষ তাঁর ‘নজিরবিহীন’ পদক্ষেপের সমালোচনায় মুখর, অন্য পক্ষ তাঁর ‘সাহসের’ বাহাবা দিচ্ছে। ই-মেইল বিতর্ক নিয়ে হিলারির বিরুদ্ধে নতুন করে তদন্ত শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন কোমি। ভোটের মাত্র ১০ দিন আগে তাঁর এ ঘোষণায় বেশ ধাক্কা খেয়ে এর ব্যাখ্যা চেয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি। এর মধ্যে দেশটির বিচার বিভাগ জানালেন, তাঁরা এ কাজ না করতে বলেছিলেন কোমিকে। কিন্তু তিনি সে কথা না রেখে নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিচার বিভাগ এ কথা বলার পরপরই হিলারির প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘দেখেছেন, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করার পরও তারা (বিচার বিভাগ) যে হিলারিকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে, তাদের এ কথা থেকেই সেটা প্রমাণিত। কাজেই তাদের কথা না রেখে এফবিআইয়ের প্রধান ঠিক কাজই করেছে।’ এ জন্য তাঁর ‘সাহসের’ প্রশংসা করছে ট্রাম্প শিবির। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের প্রধান কোমি গত শুক্রবার বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় হিলারির ব্যক্তিগত ই-মেইল সার্ভারে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান-প্রদানের ব্যাপারে তাঁরা আবার তদন্ত করতে যাচ্ছেন। গত জুলাই মাসে এই তদন্ত বাদ দেওয়া হলেও তাঁরা নতুন কিছু ই-মেইলের সন্ধান পেয়েছেন, যা ওই তদন্তের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। এর পরদিনই গত শনিবার মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল লরেটা লিঞ্চ বলেন, নির্বাচনের মাত্র ১০ দিন আগে এই ঘোষণা না দেওয়ার জন্য তিনি এফবিআইয়ের প্রধানকে বলেছিলেন। কেননা, এতে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত হতে পারে। শনিবার বিচার বিভাগের একাধিক সূত্র নাম না প্রকাশের শর্তে ওয়াশিংটন পোস্ট, সিএনএনসহ বিভিন্ন তথ্যমাধ্যমের কাছে এ কথা জানায়। মার্কিন বিচার বিভাগ বরাবর নির্বাচনী রাজনীতিতে নাক গলানোর বিপক্ষে, সে কারণে লরেটা লিঞ্চ এই মুহূর্তে তদন্ত শুরুর ঘোষণা-সংবলিত চিঠি কংগ্রেসের বিভিন্ন কমিটির প্রধানদের কাছে না পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। জেমস কোমি সেই পরামর্শ উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে চিঠিটি কংগ্রেসের নেতাদের কাছে পাঠান। ‘সন্দেহজনক’ নতুন কী তথ্য এফবিআই পেয়েছে, সে কথা স্পষ্ট নয়। জুলাই মাসে কোমি নিজে কংগ্রেসকে জানিয়েছিলেন, এক বছর ধরে হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল নিয়ে তদন্তের পর তাঁরা ‘অপরাধমূলক’ কিছু পাননি। জানা গেছে, এসব ই-মেইল নতুন কি না এবং তাতে ‘গোপনীয়’ কোনো ই-মেইল রয়েছে কি না, এফবিআই এখন তা পরীক্ষা করে দেখবে। এর জন্য ঠিক কত দিন লাগবে তা স্পষ্ট নয়। তবে অধিকাংশ গোয়েন্দা সূত্রের ধারণা, নির্বাচনের আগে তা শেষ হবে না। কোমি নিজে কীভাবে এই তদন্তের পরবর্তী ধাপ কংগ্রেস অথবা তথ্যমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করবেন, সেটিও স্পষ্ট নয়। তিনি যদি নির্বাচনের আগে অল্প অল্প করে সেই তদন্তের বিবরণ প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন, হিলারির জন্য তা রীতিমতো বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। সেই বিপদ ঠেকাতে হিলারির প্রচারশিবির ও ডেমোক্রেটিক নেতৃত্ব আপাতত কোমিকে তাঁদের সমালোচনার ‘টার্গেট’ করেছেন। সব তথ্য অবিলম্বে প্রকাশের দাবি জানানোর পাশাপাশি তাঁরা এই ঘোষণা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে বলে দেখাতে চাইছেন। শনিবার ফ্লোরিডায় এক নির্বাচনী সভায় হিলারি নিজে ব্যাপারটি উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেন। তাঁর ক্যাম্পেইন চেয়ারম্যান জন পডেস্টা সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচিত তথ্য প্রদানের মাধ্যমে কোমি রিপাবলিকান প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক হাতিয়ার তুলে দিয়েছেন। আর হিলারির ক্যাম্পেইন ম্যানেজার রবি মুক বলেছেন, বিচার বিভাগের পরামর্শ উপেক্ষা করে কংগ্রেসকে এই চিঠি দেওয়া প্রচলিত নিয়মের লঙ্ঘন। জেমস কোমির সিদ্ধান্ত উদ্দেশ্যমূলক—এ কথা প্রমাণের জন্য হিলারির শিবির সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক হোল্ডারের ২০১২ সালে লেখা একটি চিঠির প্রতি সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সেই চিঠিতে হোল্ডার স্পষ্টভাবে জানান, আইন প্রয়োগকারী ও তদন্ত কর্মকর্তারা এমন কোনো পদক্ষেপ নেবেন না, যা কোনো নির্বাচনকে প্রভাবিত করে অথবা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কোনো একজনকে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেয়। কোমি চান বা না চান, ডোনাল্ড ট্রাম্প যে এর ফলে বাড়তি সুবিধা লাভের আশা করছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যৌন হয়রানির অভিযোগের বিষয়টি আপাতত সংবাদের শিরোনাম থেকে সরে গেছে, সেটি তাঁর এই মুহূর্তের নগদ পাওনা। এখন তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে নির্বাচনী প্রচারণায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। শনিবার কলোরাডোতে এক সভায় হিলারিকে ‘ক্রিমিনাল’ হিসেবে বর্ণনা করে তাঁর বিরুদ্ধে ভোট দিতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানান ট্রাম্প। তিনি যুক্তি দেখান, হিলারি সরকারি নিয়ম উপেক্ষা করে ব্যক্তিগত সার্ভারে গোপনীয় যে তথ্য চালাচালি করেন, তা ইচ্ছাকৃত ও অপরাধমূলক। দুই শিবির যখন পাল্টাপাল্টিতে ব্যস্ত, তখন কোমি জানিয়েছেন, নতুন তথ্য পাওয়ার বিষয়টি কংগ্রেসকে না জানিয়ে উপায় ছিল না। কারণ কোনোভাবে বিষয়টি গণমাধ্যম জেনে গেল তখন নানা কথাবার্ত হতো। অধিকাংশ ভাষ্যকার মনে করেন, ই-মেইল তদন্তটি যদি অব্যাহত থাকে এবং অপরাধমূলক কোনো তৎপরতার প্রমাণ মেলে, তা হিলারির জন্য খুবই ক্ষতিকর হতে পারে। বিভিন্ন জনমত জরিপ অনুযায়ী, এমনিতেই দেশের ৬৭ শতাংশ ভোটার হিলারিকে ‘অসৎ ও বিশ্বাসযোগ্য নয়’ বলে মনে করেন। এমনকি তাঁর দলীয় সমর্থকদের মধ্যে মাত্র ৬৪ শতাংশ মানুষ হিলারির প্রতি আস্থা পোষণ করে। তাঁর জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় স্বতন্ত্র ভোটাররা। তাঁদের মধ্যে মাত্র ১৪ শতাংশ হিলারিকে সৎ বলে বিবেচনা করেন। হিলারির পক্ষে সমর্থন কমলেও সেই অনুপাতে ট্রাম্পের সমর্থন বাড়ছে, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। রিপাবলিকানদের বাইরে তাঁর সমর্থন এখনো নামমাত্র। পলিটিকোর নেওয়া এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, রিপাবলিকানদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ ট্রাম্পের পক্ষে। তবে মোট ভোটারদের মাত্র ৩৭ শতাংশ তাঁর সঙ্গে রয়েছে। নির্বাচনী কোনো পর্যায়েই ট্রাম্পের সমর্থন ৪২ শতাংশের বেশি হয়নি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.