যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ‘লেজেগোবরে অবস্থা করে দিয়েছেন এফবিআই পরিচালক জেমস কমি’। এ নিয়ে উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে। ঝড়ো হাওয়া বইছে সর্বত্র। নির্বাচনের দু’সপ্তাহেরও কম সময় বাকি থাকতে মার্কিন কংগ্রেসের কাছে একটি চিঠি লিখেছেন এফবিআই প্রধান জেমস কমি। তাতে তিনি জানিয়েছেন, তার এজেন্সি হিলারি ক্লিনটনের বেশ কিছু নতুন ই-মেইল পেয়েছে। তা নিয়ে তারা অনুসন্ধান করছেন। ব্যস, এ পর্যন্তই। এতেই নির্বাচনের মাঠে বইছে ঘূর্ণিবাতাস। ডেমোক্রেট শিবির থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্যই এমন সময়ে কংগ্রেসে ওই চিঠি দিয়েছেন জেমস কমি। এ বিষয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়ে তাকে চিঠি লিখেছেন কংগ্রেসের সিনেটে ডেমোক্রেট নেতা হ্যারি রেইড। একজন কংগ্রেসম্যান তো জেমস কমির পদত্যাগও দাবি করেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের একজন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, সঠিক কাজ করতে বড় একটি ভুল করেছেন জেমস কমি। হ্যারি রেইড তার চিঠিতে বলেছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে জেমস কমি ফেডারেল আইন ভঙ্গ করে থাকতে পারেন। এখন প্রশ্ন হলো- আসলেই কি জেমস কমি ফেডারেল আইন ভঙ্গ করেছেন? বিশেষ করে ১৯৩৯ সালের ‘হ্যাচ অ্যাক্ট’! এই আইনের অধীনে কোনো ফেডারেল কর্মচারী সরাসরি কোনো প্রার্থীকে নির্বাচনে সমর্থন দিতে পারেন না। এসব নিয়ে অনলাইন সিএনএনে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন সাংবাদিক স্টিভ ভ্লাদেক। হ্যাচ অ্যাক্ট কী ১৯৩৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসনাল নির্বাচন হয়। তখন প্রার্থীদের কোনো কোনো ফেডারেল কর্মচারী সরাসরি সমর্থন দিচ্ছেন বলে উদ্বেগ দেখা দেয়। এরই ভিত্তিতে মার্কিন কংগ্রেস পাস করে হ্যাচ অ্যাক্ট। এর উদ্দেশ্য হলো, বেশির ভাগ ফেডারেল কর্মচারীকে রাজনৈতিক নির্বাচনে জড়িত হওয়া থেকে বিরত রাখা। এর অধীনে সরকারি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কোনো ফেডারেল কর্মচারী কোনো প্রার্থীর জন্য উপযাচক হয়ে ডোনেশন বা অর্থ সহায়তা দিতে পারেন না। সক্রিয়ভাবে কোনো প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে পারেন না। অথবা কোনো কর্মচারী নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার উদ্দেশে বা নির্বাচনের ফলের উপর প্রভাব ফেলতে সরকারি পদ বা প্রভাব ব্যবহার করতে পারেন না। এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করে ‘ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট’ দুবার প্রত্যাখ্যান করে সুপ্রিম কোট। এই আইনটি ৭৭ বছরের পুরনো। বারবার এটি সংশোধন করেছে মার্কিন কংগ্রেস। সমপ্রতি এটি সংশোধন করা হয়েছে ২০১২ সালে। তাতে এ আইনটি লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণির সরকারি কর্মচারীকে পদত্যাগ না করে রাজনৈতিক পদে দায়িত্ব পালনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিভাবে এটি ব্যবহার করা হয় হ্যাচ অ্যাক্ট প্রকৃতপক্ষে সুস্থতার সঙ্গে নিয়মিতভাবে প্রয়োগ করা হয়। যদিও এসব ঘটনা জাতীয় পর্যায়ে একই রকম শিরোনাম হয় না। এ আইনটি ভঙ্গ করলে ডিসিপ্লিনারি একশন নেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে সাময়িক বরখাস্ত, জরিমানা, পদাবনতি, দায়িত্বে সীমাবদ্ধতা। তবে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে চাকরি থেকে বরখাস্তও করা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা এ আইন লঙ্ঘন করে তাদের জেলে যেতে হয় না। কারণ, হ্যাচ অ্যাক্ট লঙ্ঘন করা কোনো ফৌজদারি অপরাধ নয়। উল্টো এটি হলো সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে একটি প্রশাসনিক বিধান। এ আইনটি প্রয়োগ করে থাকে একটি বিশেষ স্বাধীন ফেডারেল এজেন্সি। এর নাম অফিস অব স্পেশাল কাউন্সিল। তারাই অভিযোগ তদন্ত করে। তারপর অভিযোগের মেরিট যাচাই করে। তারপর তারা সিদ্ধান্ত নেয়- অভিযুক্ত কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তারাই নেবে নাকি বিষয়টি ফেডারেল আরেকটি ইজেন্সির কাছে হস্তান্তর করবে। অভ্যন্তরীণ সরকারি কর্মচারীদের এমন বিষয়টি দেখাশোনা করে মেরিট সিস্টেমস প্রটেকশন বোর্ড। জেমস কমির মতো যেসব কর্মকর্তাকে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিয়ে থাকেন তাদের জন্য অভিযোগের একটি রিপোর্ট অফিস অব স্পেশাল কাউন্সিল জমা দিয়ে থাকে প্রেসিডেন্টের কাছে। প্রেসিডেন্টই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন ওই কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে কিনা। চূড়ান্তভাবে হ্যাচ অ্যাক্টের বিষয়ে অনেক ফেডারেল এজেন্সি তাদের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়। তাদেরকে আগেই বলে দেয়া হয় কিভাবে তারা এ আইন লঙ্ঘন এড়িয়ে যেতে পারেন, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ে। এফবিআই প্রধান জেমস কমির মতো ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের আইন মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালের মার্চে একটি মেমো প্রকাশ করেছে। তাতে কর্মচারীদের নির্বাচনী বছরে তাদের আইন সম্পর্কে সচেতন করে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত না হতে বলা হয়েছে। তাতে কোনো একটি রাজনৈতিক দল, প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী অথবা দলীয় কোনো গ্রুপের সফলতা বা ব্যর্থতায় সরাসরি জড়িত না হতে বলা হয়। জেমস কমি কি হ্যাচ অ্যাক্ট ভঙ্গ করেছেন জেমস কমির বিষয়টি হ্যাচ অ্যাক্টের ‘৫ ট.ঝ. ঈড়ফব ্ম ৭৩২৩ (ধ)(১)’ অধীনে পড়ে। এই বিধানে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা তার সরকারি পদ ব্যবহার করে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ অথবা নির্বাচনে ফলের ওপর প্রভাব ফেলে এমন কিছু করতে পারবেন ন। এ ক্ষেত্রে পরিষ্কার বিধিনিষেধ রয়েছে। তবে এই আইনে কর্মচারী কি করেছেন সেদিকে দেখা হয় না। কিন্তু তিনি কি উদ্দেশ্যে করেছেন সেদিকটি দেখা হয়। তাই আসন্ন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার বা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশে যদি জেমস কমি মার্কিন কংগ্রেসে চিঠি দিয়ে না থাকেন, তাহলে তিনি হ্যাচ অ্যাক্ট লঙ্ঘন করেননি। তবে অবশ্যই উদ্দেশ্য কি ছিল তা শুধু জেমস কমিই ভালো জানেন। কিন্তু হোয়াইট হাউসের সাবেক চিফ অব ইথিকসের প্রধান আইনজীবী রিচার্ড ডব্লিউ পেইন্টার রোববার নিউ ইয়র্ক টাইমসের মন্তব্য কলামে লিখেছেন, মার্কিন কংগ্রেসে জেমস কমির চিঠি পাঠানোর উদ্দেশ্য নিয়ে পর্যাপ্ত কারণের অনুপস্থিত ছিল। নির্বাচনে একজন প্রার্থীর বিষয়ে চলমান বা মুলতবি হয়ে যাওয়া এফবিআইয়ের তদন্তের বিষয়টি জনগণের সামনে প্রকাশ করা হয়েছে নির্বাচনের প্রাক্কালে। এর মধ্য দিয়ে হ্যাচ অ্যাক্ট লঙ্ঘিত হয়েছে বলেই মনে হয় এবং তিনি সরকারি পদের অপব্যবহার করেছেন। সিনেট সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা হ্যারি রেইড হ্যাচ অ্যাক্টের বিষয়টি রোববার এক চিঠিতে তুলে ধরেছেন জেমস কমির কাছে। তাতে তিনি লিখেছেন, আমি আপনাকে জানাতে চাই যে, আমার অফিস নিশ্চিত হয়েছে, (আপনার) এসব কর্মকাণ্ড হ্যাচ অ্যাক্ট লঙ্ঘন করেছে। আপনার পক্ষপাতমূলক কর্মকাণ্ড এ আইন ভঙ্গ করে থাকবে। ওদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে শনিবার অফিস অব স্পেশাল কাউন্সিল ও অফিস অব গভর্নমেন্ট ইথিকসে অভিযোগ জমা দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে জেমস কমির উদ্দেশ্য বা আচরণ নিয়ে তদন্ত দাবি করা হয়েছে। এ অভিযোগ যেভাবেই নেয়া হোক, নির্বাচন দিনের আগে এ বিষয়ে কোনো সুরাহা পাওয়া যাবে না। যদি কমির চিঠি হ্যাচ অ্যাক্ট লঙ্ঘন করে না থাকে তাহলে তা ওই আইনের যে মেজাজ আছে তাকে লঙ্ঘন করে থাকতে পারে। জেমস কমিকে কি বরখাস্ত করা হবে চূড়ান্ত বিচারে বলতে হয়, যদি কোনো ফেডারেল কর্মকর্তা মারাত্মকভাবে এ আইন লঙ্ঘন করে থাকেন তাহলেই এ আইনের অধীনে কর্তৃপক্ষ ওই কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করতে পারে। কিন্তু জেমস কমির উদ্দেশ্য নিয়ে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে না হয়তো, ফলে তাকে এ আইন লঙ্ঘনের জন্য তাকে অভিযুক্ত করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে অফিস অব স্পেশাল কাউন্সিল। একই কারণে মেরিট সিস্টেম প্রটেকশন বোর্ড তাকে বরখাস্তের নির্দেশ দেয়ার ক্ষেত্রেও জটিল অবস্থায় পড়তে পারে। অন্যদিকে তিনি নিয়োগ পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট দ্বারা। তার মেয়াদ ১০ বছর। তার মেয়াদ শেষ হবে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যেহেতু নিজেই তাকে নিয়োগ করেছেন তাই তিনি নিজে বা তার উত্তরসূরি জেমস কমিকে বরখাস্ত করতে পারবেন। এতে কোনো কিছুই প্রেসিডেন্টকে আটকাবে না।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.