ইচ্ছাশক্তি থাকলে পাহাড়সম বাধাও যে অতিক্রম করা যায়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হাফিজুর রহমান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) অধ্যয়নরত এই তরুণ মুখে লিখেই পাস করেছেন স্নাতক। এখন পড়ছেন স্নাতকোত্তর শ্রেণির প্রথম সেমিস্টারে।
২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে কোনো কোচিংয়ে ভর্তি না হয়েই জবির ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান করে নেন হাফিজুর। এর পর ভর্তি হন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। তখন থেকেই সংগ্রাম করে যাচ্ছেন তিনি। পরীক্ষার হলে মেঝেতে পাটিতে বসে ছোট টুলে খাতা রেখে মুখ দিয়ে লিখে পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন এই যুবক।
বিকলাঙ্গ দুই হাত ও দুই পা নিয়ে ১৯৯৩ সালে বগুড়ার ধুনট উপজেলার বেলকুচি গ্রামে কৃষক পরিবারে জন্ম নেন হাফিজুর। বাবা পক্ষাঘাতের রোগী কৃষক মো. হাফিজুদ্দিন, মা গৃহিণী ফিরোজা বেগম। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। তাঁর তিন ভাই বিয়ে করে নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত।
এ প্রসঙ্গে হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা চার ভাই। সবাই বিয়ে করে তাদের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। কেউ বাবা-মাকে সাহায্য করতে পারে না।
‘আমি যদি ভালো কিছু করতে পারি, তাহলে আমার ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার যাবতীয় খরচ আমি বহন করব’, যোগ করেন হাফিজুর।
জীবনে প্রথম বাবার কাছেই ‘বর্ণ পরিচয়’ শেখা শুরু হাফিজুরের। বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ব্র্যাক স্কুলে শুরু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন। সে সময় বেয়ারিংয়ের গাড়িতে করে সহপাঠীরা স্কুলে নিয়ে যেত তাঁকে। এভাবেই স্কুলে যাওয়া-আসার মধ্যে ২০০৯ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪.১৯ পেয়ে উত্তীর্ণ হন জ্ঞানপিপাসু হাফিজুর। তারপর ধুনট ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০১১ সালে এইচএসসিতে জিপিএ ৩.৬০ পেয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি।
হাফিজুর এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘যখন প্রথম প্রথম পড়ালেখা শুরু করেছিলাম, তখন অনেকেই হেসেছেন। আবার কেউ বা বাড়িয়ে দিয়েছে সহযোগিতার হাত। তবে সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ থাকব আমার সাবেক ও বর্তমান সহপাঠীদের প্রতি, যাঁদের একান্ত প্রচেষ্টায় জয় করতে সক্ষম হয়েছি আমার এ ধরনের শারীরিক অপূর্ণতা।’
‘আমার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ও অর্থভাবে ক্লাস করতে পারি না। এ জন্য আমাকে প্রথম বর্ষে কোনো উপস্থিতি নম্বর দেয়নি। পরের বছর থেকে আমাকে কোনো কোনো শিক্ষক ৫০ শতাংশ নম্বর দিলেও আবার কোনো শিক্ষক দেয় না।’
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উদ্দেশে হাফিজুর বলেন, ‘নিজের শরীরের দিকে না তাকিয়ে আমাদের উচিত লক্ষ্য স্থির করা। তাহলে আমরা সমাজের বোঝা হয়ে থাকব না। আমরা প্রতিযোগিতার সাধারণ মানুষের মতোই অংশগ্রহণ করতে চাই।’
আপাতত নিজের পড়ালেখার খরচ ও অসুস্থ বাবা-মাকে সহযোগিতা করার জন্য ক্যাম্পাসে ব্যাগের সঙ্গে সঙ্গে বই-খাতা-কলম বিক্রির পরিকল্পনা করেছেন হাফিজুর। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে এ সুযোগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
হাফিজুর বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইবোনদের যত খাতা-কলম-ব্যাগ লাগে, তা আমার এখান থেকে কিনবেন তাঁরা। এতে আমি একজন অসহায় ভাই কিছু উপার্জন করার সুযোগ পাব। ভালোভাবে শেষ করতে পারব নিজের পড়ালেখাও।’
হাফিজুর জানান, তাঁর উচ্চশিক্ষা অর্থের অভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। নিজের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। যদিও নিজের পাশাপাশি বাড়িতে পঙ্গু বাবার চিকিৎসার খরচ, মায়ের ভরণপোষণ এবং খালাতো ভাই মো. রাব্বির লেখাপড়ার দায়িত্বও নিয়েছেন তিনি।
অতীতে কয়েকটি সংগঠনের সহযোগিতা পেলেও বর্তমান মাত্র একটি সংগঠন থেকে নামমাত্র কিছু টাকা পান তিনি। তাই তো নিজস্ব উদ্যোগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো লাগানো বেশ কিছু ব্যাগ বিক্রি করতে বসেন নিজের ক্যাম্পাসের ভাস্কর্য চত্বরে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.