রাজধানীর কল্যাণপুরে গত ২৬শে জুলাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত হয় ৯ জঙ্গি। তখন সবার পরিচয়ই অজ্ঞাত ছিল। অজ্ঞাত লাশগুলো নেয়া হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে। ওই দিনই নিহতদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নির্বাচন কমিশনের তথ্য ভাণ্ডারে সংরক্ষিত জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে মিলানো হয়। তাৎক্ষণাত বেরিয়ে আসে ৭ জঙ্গির পরিচয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে এই সমস্যার কিনারা করতে সমর্থ হয় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। একইভাবে সকল অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তের দায়িত্বও একই পুলিশ বিভাগের। অথচ বছরের পর বছর হাজার হাজার অজ্ঞাত লাশের পরিচয় জানার জন্য অনুসরণ করা হচ্ছে না ফলপ্রসূ এই পদ্ধতি। শুধু তাই নয়। হচ্ছে না অজ্ঞাত লাশের ডিএনএ টেস্ট। সংরক্ষণ হচ্ছে না ডিএনএ প্রোফাইল। ফলে প্রতি বছর সহস্রাধিক অজ্ঞাত লাশের পরিচয় মিলছে না। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেবল ঢামেক হাসপাতালে আসা ১০৮ পুরুষ ও নারীর লাশ অজ্ঞাত হিসেবে দাফন হয়েছে। বিকৃত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া লাশগুলোর পরিচয় কখনও জানতে পারবে না তাদের স্বজনরা। যথাযথ উদ্যোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর জনসম্পৃক্ত প্রচারের পরিবর্তে পুলিশের গতানুগতিক কার্যক্রম ও অবহেলার কারণেই প্রতি বছর সহস্রাধিক লাশ অজ্ঞাত অবস্থায় দাফন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে নিহতের পরিবাররা জানতে পারছে না তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজনরা বেঁচে আছেন, না মরে গেছেন। কোথায় দাফন হয়েছে? ফলে দীর্ঘ অনুসন্ধানের পাশাপাশি শূন্যতার হাহাকার নিয়েই তারা পার করছেন বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ। পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় উদঘাটন হচ্ছে না বহু গুপ্তহত্যার রহস্য। বিচারের আওতায় আসছে না অনেক চাঞ্চল্যকর অপরাধ। অধরা রয়ে যাচ্ছে খুনি ও সহযোগীরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ মানবজমিনকে বলেন, পুলিশ অজ্ঞাত লাশের ছবি তুলে বোর্ডে টানায়। সুরতহাল করে। নিজেদের প্রচলিত ব্যবস্থায় থানায় থানায় প্রচারও করে। কিন্তু পুলিশের বর্তমান প্রচলিত ব্যবস্থায় অধিকাংশ অজ্ঞাত লাশের পরিচয় জানা যাচ্ছে না। সমপ্রতি কল্যাণপুরের ৭ জঙ্গির লাশ ফিঙ্গার প্রিন্ট মিলিয়ে শনাক্ত হয়েছে। পরে নিহত আরো কয়েক জঙ্গির লাশেরও পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে একই পদ্ধতিতে। তথ্যপ্রযুক্তির এই সুবিধাটি কাজে লাগানো হলে অন্তত ৭০ ভাগ অজ্ঞাত লাশের পরিচয় জানা সম্ভব। তবে বিকৃত লাশের পরিচয় এভাবে জানা যাবে না। এজন্য প্রয়োজন ডিএনএ টেস্ট। টেস্টের পর সংরক্ষিত লাশের ডিএনএ প্রোফাইলের সঙ্গে স্বজনদের ডিএনএ মিলিয়ে দেখে বহু বছর পরও পরিচয় জানা যাবে। স্বজনরা জানতে পারবে কোথায় দাফন হয়েছে। এ দু’উপায়ে অন্তত ৮০ ভাগ অজ্ঞাত লাশের পরিচয় বেরিয়ে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢামেক হাসপাতাল ও ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬শে জুলাই নিহত ৯ জনের মধ্যে ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে জঙ্গি আবদুল্লাহ, আবু হাকিম নাইম, তাজ-উল-হক রাশিক, আফিকুজ্জামান খান, সেজাদ রউফ অর্ক, মতিয়ার রহমান ও মো. জোবায়ের হোসেনের পরিচয় জানতে পারে পুলিশ। পরে আরো একজনের পরিচয় জানা যায়। অথচ গত ২৬শে আগস্ট রাজধানীর শাপলা চত্বর এলাকা থেকে এক ব্যক্তিকে আহত অবস্থায় উদ্ধারের পর ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করে র্যাব-৩। ৫ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১লা সেপ্টেম্বর আনুমানিক ৩৫ বছরের ওই ব্যক্তি মারা যায়। হাসপাতালে ও পুলিশের হাতের কাছে থাকা সত্ত্বেও ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে ওই অজ্ঞাত লাশের পরিচয় জানার জন্য চেষ্টা হয়নি। বরং লাশটি নিয়ে র্যাব ও মতিঝিল থানা পুলিশের দায়িত্ব এড়ানোর গড়িমসি চলে প্রায় একমাস ধরে। অবশেষে মতিঝিল নয়, শাহবাগ থানা পুলিশই লাশটির সুরতহাল করে। তারপর ময়নাতদন্ত হয়। জীবিত অবস্থায় ভর্তির পরও পুলিশি অবহেলায় অবশেষে অজ্ঞাত ওই ব্যক্তির লাশও অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করেছে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। এভাবে প্রতি বছর কেবল ঢামেক হাসপাতালেই শনাক্ত হচ্ছে না শতাধিক লাশের পরিচয়। এর আগে গত ১৩ই সেপ্টেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আনুমানিক ২৬ বছরের এক অজ্ঞাত যুবক। তার পরিচয় ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে জানা সম্ভব ছিল। কিন্তু তা ছাড়াই শাহবাগ থানা পুলিশের সুরতহাল ও ফরেনসিক বিভাগের ময়নাতদন্তের পর দাফন হয়েছে অজ্ঞাত হিসেবে। একই মাসে গত ৪ ও ১০ই সেপ্টেম্বর আনুমানিক ৩০ ও ৩৫ বছরের দু’পুরুষের সুরতহাল করলেও পরিচয় শনাক্তে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। গত ২৫শে সেপ্টেম্বর আনুমানিক ৩০ ও ৪০ বছরের আরো দু’পুরুষ ও মহিলার সুরতহালের পর পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি একই থানা পুলিশ। গত সেপ্টেম্বরেই ঢামেক হাসপাতাল মর্গে আসা এক নারীসহ ১২ লাশের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ, ছুরিকাঘাত ও মাথায় আঘাতে খুনের শিকার হয়েছে এক নারীসহ ৩ জন। ৫ জন নিহত হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়। একজন বিষপানে। দু’জনের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে আনার আগেই। পৃথক কারণে মৃত্যু হয়েছে অপরজনের। চলতি বছর জানুয়ারি গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ৯ মাসে ঢামেক হাসপাতালে আসা ও সেখান থেকে অজ্ঞাত হিসেবে দাফন হওয়া লাশের সংখ্যা ১০৮। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১৬, ফেব্রুয়ারিতে ৭, মার্চে ১১, এপ্রিলে ৯, মে’তে ১৩, জুনে ১৮, জুলাইয়ে ১১, আগস্টে ১৮ ও সেপ্টেম্বরে ১২ লাশের পরিচয় জানা যায়নি। ওই ১০৮ অজ্ঞাত লাশের মধ্যে ৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়। গুলিবিদ্ধ ও ছুরিকাহত হয়ে ২ জন করে ৪ জন এবং মাথায়সহ শরীরে আঘাত করে খুন করা হয়েছে আরো ৭ জনকে। বিষপানে মারা গেছে ১৫ জন। হাসপাতালে আনার আগেই মৃত্যুবরণ করেছে ২১ জন। এছাড়া, ট্রেন দুর্ঘটনায় ১ জনসহ কয়েকটি কারণে অপর ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। খুনের শিকার হওয়া অন্তত ৯ জনের পরিচয় জানা না যাওয়ায় উদঘাটন হয়নি হত্যা রহস্যও। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার কয়েকঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছালেও ফিঙ্গার প্রিন্ট মেলানোর ব্যবস্থা না থাকায় নিহত অনেকের পরিচয় জানা যায় না। আর বেশি লোক অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে দাফন হচ্ছে। এদিকে রাজধানীর শাহবাগ থানার হিসাবে দেখা গেছে, গত আগস্টে এক নারীসহ ৯ লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। এরমধ্যে বিষক্রিয়ায় ৩ ও সড়ক দুর্ঘটনায় দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৫শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ নারীসহ আরো ৫ জনের পরিচয় শনাক্তেও ব্যর্থ হয়েছে একই থানা। অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবে থানা পুলিশ সুরতহাল সম্পন্ন করে। ময়নাতদন্ত করে ফরেনসিক বিভাগ। তারপর আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন। কেবল ঢামেক হাসপাতাল বা রাজধানীর শাহবাগ থানা নয়। সারা দেশের সব হাসপাতাল ও থানার চিত্র প্রায় অভিন্ন। পরিচয় শনাক্তে ফিঙ্গার প্রিন্টসহ যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে গতানুগতিক ও দায়সারাভাবে সারছে এই স্পর্শকাতর গুরুত্বপূর্ণ কাজটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা হাসপাতাল মর্গেও ঘটছে একই অবহেলা। গত ৯ই অক্টোবর হাসপাতালগুলোর ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা ঢামেক’তে একটি সভা শেষে এই প্রতিবেদকের কাছে তা তুলে ধরেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের ৬৪ জেলার প্রায় সব থানায় একই কারণে পরিচয় শনাক্ত ছাড়াই দাফন হচ্ছে লাশ। আবার অজ্ঞাত লাশের মধ্য থেকে অক্ষত বেশকিছু লাশ মেডিকেল শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। লাশ বা কংকাল দু’ভাবেই বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ঠাঁই মিলছে। ঠাঁই হচ্ছে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের পড়ার কক্ষেও। পুলিশ ও সংস্থাটির অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জানায়, সাধারণত অজ্ঞাত লাশ পাওয়া গেলে তা পুলিশের ওয়্যারলেসে ঘোষণা দিয়ে দেশের সব থানায় জানিয়ে দেয়া হয়। তোলা হয় লাশের ছবি। ওই ছবি থানায় টাঙানো হয়। পাঠানো হয় বিভিন্ন থানায়। প্রকাশ করা হয় নিজেদের ওয়েবসাইটে (সিডিএমএস-ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম)। ওই লাশের ছবি ও বর্ণনা দিয়ে তিন মাস পর পর সিআইডি গেজেটও প্রকাশ করে। রাজধানীতে লাশের ছবি তুলে তা টানানোর দায়িত্ব পালন করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। স্বজনদের শনাক্তের জন্য মর্গে লাশ রাখা হয় কয়েকদিন। এরমধ্যে লাশের খোঁজে কেউ না আসলে তা আর শনাক্ত হয় না। সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের পর আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে দাফন করা হয়। অথচ মর্গে লাশ আসার পর পর ফিঙ্গার প্রিন্টের ব্যবস্থা নেয়া হলে অধিকাংশ লাশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব বলে জানান চিকিৎসক, প্রযুক্তিবিদ ও পুলিশ কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষেরও সচেতনতা প্রয়োজন এবং সবার পকেটে সব সময় নিজের পরিচয়পত্র বা পরিচয় লেখা কাগজ ও প্রয়োজনীয় কিছু ফোন নম্বর রাখলে অন্তত অজ্ঞাত হিসেবে দাফন হতে হবে না বলে পরামর্শ দেন তারা। সিআইডির ক্রিমিনাল ইন্টিলিজেন্স ব্যুরোর (সিআইবি) এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, লাশের পরিচয় শনাক্তে পুলিশের বর্তমান গতানুগতিক কার্যক্রমে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। ফিঙ্গার প্রিন্ট মেলানো ও জনসম্পৃক্ত প্রচারণায় এ সমস্যা দ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব। ডিএমপি’র উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, নির্বাচন কমিশনের তথ্য ভাণ্ডারে সংরক্ষিত জাতীয় পরিচয়পত্রের ফিঙ্গার প্রিন্ট পুলিশ ব্যবহার করতে পারলে এ ক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়া যাবে। পুলিশ এই সুবিধা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। তবে লাশের পরিচয় শনাক্তে অবহেলা নেই। যা যা করা প্রয়োজন পুলিশ তা করছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.