বর্তমান সময়ে সারাবিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুর নাম মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন। মার্কিনিরা তো বটেই, বলতে গেলে সারাবিশ্বই নজর রাখছে এই নির্বাচনে। এই নির্বাচনের দুই প্রার্থী ডেমোক্রেট দলের হিলারি ক্লিনটন আর রিপাবলিকান দলের ডনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে চলছে লড়াই। তাদের এই লড়াইকে কেমনভাবে দেখছে বাকি বিশ্ব? প্রভাবশালী বৃটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা খোঁজ করেছেন তারই। তারা তুলে ধরেছেন সেসব দেশে হিলারি বা ট্রাম্পকে নিয়ে ভাবনাগুলো এবং সার্বিকভাবে মার্কিন নির্বাচনকে কীভাবে দেখা হচ্ছে। আজ শেষ কিস্তিতে থাকছে জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও ইরাকের কথা। গার্ডিয়ান অবলম্বনে লিখেছেন তরিকুর রহমান সজীব জার্মানি জার্মানির প্রেসিডেন্ট পদে হিলারি ক্লিনটনকে ডনাল্ড ট্রাম্পের বিপক্ষে লড়তে হলে ভূমিধস বিজয় পেতেন হিলারি। অক্টোবর মাসে ইনফ্রাটেস্ট ডিম্যাপ পরিচালিত এক জরিপে জার্মানদের মধ্যে ৮৬ শতাংশের সমর্থন দেখা যায় হিলারির প্রতি। এর আগের এক জরিপে এএফডির মতো ডানপন্থি সমর্থকদের মধ্যেও সমর্থন বেশি ছিল হিলারির প্রতিই। ট্রাম্পের পক্ষে সমর্থন ছিল মাত্র এক-চতুর্থাংশের। জার্মানরা মনে করছেন, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অস্থিতিশীলতা রয়েছে তা আরো বাড়বে। রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে জার্মানি এতে করে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সংবাদপত্র ডিয়ে ওয়েল্ট লিখেছে, ‘ডনাল্ড ট্রাম্প আমাদের সমৃদ্ধির জন্য বিপদের কারণ হতে পারেন।’ আবার ডের স্পিগেল এটাও জানিয়েছে যে, হিলারির প্রেসিডেন্ট হওয়া নিয়েও জার্মানদের মধ্যে উচ্ছ্বাস নেই। পত্রিকাটির ভাষ্য, ‘জনসম্মুখে হিলারির আগমন সুখকর না হলেও তার ওপর থেকে আমাদের আস্থা হারালে চলবে না। কতবার অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের বিরুদ্ধে উৎসাহের ঘাটতি দেখা গেছে? কিন্তু তিনিই এখন বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত রাজনীতিবিদদের একজন।’ জার্মান চ্যান্সেলর নিজে মার্কিন নির্বাচন নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। ট্রাম্প একাধিকবার জার্মানিকে আক্রমণ করে কথা বললেও মার্কেল কোনো ধরনের মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছেন। তবে মার্কেলের রাজনৈতিক অবস্থানের কথাও অজানা নয়। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবার অনেক বেশি স্পষ্টভাষী। গত আগস্ট মাসে কূটনৈতিক রীতিনীতির বাইরে গিয়েই তিনি ট্রাম্পকে ‘ঘৃণা প্রচারক’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। ফ্র্যাংক-ওয়ালটার স্টেইনমেয়ার খোলাখুলিই বলেছিলেন, তিনি মার্কিন নির্বাচন প্রসঙ্গে ‘নিরপেক্ষ নন’। রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পের বিভিন্ন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তিনি এটাও বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে তা ‘বিশ্বের জন্য ভয়ংকর হবে’। ইতালি মার্কিনিদের সঙ্গে ইতালির বরাবরই সুসম্পর্ক রয়েছে। দেশটিতে সমর্থনের পাল্লা ভারি হিলারির দিকে। এক জরিপে দেখা যায়, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হিলারির প্রতি সমর্থন ৬৩ শতাংশ ইতালিয়ানের। ইতালিয়ানরা এটা ভালো করেই জানেন যে ট্রাম্পকে তুলনা করা হয় তাদেরই দুই সাবেক ফ্যাসিস্ট নেতা বেনিতো মুসোলিনি ও সিলভিও বার্লুসকোনির সঙ্গে। ঘটনার প্রেক্ষিতে ট্রাম্পকে ‘আমেরিকার বার্লুসকোনি’ ট্যাগও দেয়া হয়েছে। লা রিপাবলিকাতে কলামনিস্ট ভিত্তোরিও জুকোনি লিখেছেন, দুজনের মধ্যে সুনিশ্চিত মিল থাকলেও তাদের চুলের ধরন, নারীদের যৌন পণ্য হিসেবে দেখা, তাদের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ- এগুলো সবই সুনির্দিষ্ট একটি শ্রেণির ভোটারদের মন জয় করেছে, যারা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে ঘৃণা করেন। এসব ভোটারের মধ্যে ট্রাম্পের চারিত্রিক দুর্বলতা কোনোভাবেই তার জনপ্রিয়তার জন্য হুমকি নয়। উভয়েই কেবল তাদের নিজস্ব ধ্বংসাত্মক প্রবণতার মাধ্যমেই পরাজিত হতে পারেন। ইল সোলে ২৪ ওর-এর সাবেক সম্পাদক জিয়ানি রিওত্তা বলেছেন, ‘বিপর্যয়কর’ একজন প্রধানমন্ত্রী হলেও বার্লুসকোনি ট্রাম্পকে যতটা দেখা গেছে, তার তুলনায় অনেক বেশি চতুর রাজনীতিবিদ ছিলেন। সেটা জর্জ ডব্লিউ বুশ ও ভ্লাদিমির পুতিনকে বন্ধু ধরে নিয়েই। বার্লুসকোনিকে ট্রাম্পের তুলনায় ভালো ব্যবসায়ী বলেও অভিহিত করেন রিওত্তা। ইতালিতে হোয়াইট হাউসের দৌড়কে প্রায় সবসময়ই নিজেদের ভঙ্গুর রাজনৈতিক পটভূমির দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হয়। ইতালির রাজনৈতিক নেতারাও নির্বাচনের প্রার্থীদের পক্ষে অবস্থান নেয়া থেকে বিরত থাকেন না। প্রধানমন্ত্রী মাত্তেও রেনজি তার ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান হিসেবে দলের অবস্থান অনুযায়ীই হিলারির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। সেটা প্রাইমারিতে হিলারি জয়ী হওয়ার আগ থেকেই। অন্যদিকে, নর্দার্ন লীগের প্রধান মাত্তেও সালভিনি আবার ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জানাতে যুক্তরাষ্ট্রেই সফর করেছেন। ইতালির রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত প্রতিষ্ঠানবিরোধী ফাইভ স্টার গ্রুপ আবার সমর্থন করছে গ্রিন পার্টির প্রার্থী জিল স্টেইনকে। যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এরই মধ্যে তাদের পছন্দের প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের বিজয়ে স্বস্তি প্রকাশের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। হিলারিকে তারা নির্ভরযোগ্য একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখছেন যার ইউরোপের সঙ্গে সংযোগে আবেগও থাকবে। তাছাড়া, নতুন করে রাশিয়ার হুমকি ও সিরিয়া সংকটে সমাধানেও যিনি আবেগ নিয়ে কাজ করবেন। বৃটেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ব্রেক্সিটের প্রেক্ষিতেও মিলিয়ে দেখছে। ব্রেক্সিটের ফলে যুক্তরাজ্যের আরো বিচ্ছিন্ন পররাষ্ট্রনীতির যে সম্ভাবনা রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক সেটাকে কমিয়ে আনতে পারে। ডেভিড ক্যামেরন ও ওবামার মেয়াদে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কখনই খারাপ ছিল না। তবে কিছু কিছু ইস্যুতে তাদের মধ্যে ছিল বিরোধ। যেমন- ২০১৩ সালে সিরিয়াতে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে যৌথ সামরিক বাহিনী নিয়োজিত করায় এক হতে পারেননি তারা। ব্রেক্সিট নিয়ে ক্যামেরনের ঝুঁকিপূর্ণ ও চূড়ান্তভাবে বিপর্যয়কর গণভোট আয়োজনের ইস্যুতে বিরোধ ছিল। লিবিয়া থেকে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স মনোযোগ হারিয়েছে বলেও সমালোচনা ছিল ওবামার। সিরিয়া যুদ্ধে সৃষ্ট শরণার্থী সংকটকে মোকাবিলায় ওবামার সক্ষমতা নিয়েও ছিল প্রশ্ন। হিলারি আশা করবেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বৃটেনের বেরিয়ে যাওয়াটা বিশ্ব অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করবে না। ব্রেক্সিট যতটা নমনীয় হবে, হোয়াইট হাউসের জন্য সেটা ততটাই সুখকর হবে। হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে এটাও আশা করবেন যে ব্রেক্সিট ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিতে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। হিলারিকে হয়তো বৃটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হতে পারে, যা নিয়ে পররাষ্ট্র দপ্তরকে জটিলতায় পড়তে হবে। বৃটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন এরই মধ্যে সিরিয়ায় নো ফ্লাই জোনের পক্ষে হিলারির দীর্ঘদিনের সমর্থনের পক্ষেই কথা বলেছেন। হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে যদি পুতিনের প্রতি আরো আগ্রাসী মনোভাব নেন, বৃটেন তার সঙ্গেই থাকবে। বর্তমানে বৃটেন আলঙ্কারিক অর্থে এর অগ্রভাগেই রয়েছে। তবে হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে হয়তো আরো বাস্তবিক সমর্থন মিলতে পারে। যুক্তরাজ্য এর প্রতিরক্ষা বাজেট ও ট্রাইডেন্ট পারমাণবিক সাবমেরিন কর্মসূচির নবায়নে স্থিতিশীলতা চাইবে। কোনো বাণিজ্য চুক্তি না হলেও নিরাপত্তার প্রশ্নে বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোতে সৈন্য পাঠিয়ে অগ্রভাগে থাকার ইচ্ছাও পোষণ করবে। ইরাক ইরাক এখন আইএসের কাছ থেকে মসুল পুনর্দখল নিতে ব্যস্ত। আগামী বছরের নির্বাচনের ব্যস্ততাও রয়েছে। ফলে মার্কিন নির্বাচন নিয়ে সাড়া-শব্দ একটু কম, ইরাকের ভবিষ্যতের জন্য তা গুরুত্বপূর্ণ হলেও। আইএসের বিরুদ্ধে ইরাকের লড়াইয়ে মার্কিন সামরিক ও আর্থিক সহায়তার নবায়ন চুক্তি ইরাকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে জিহাদিদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি মসুল দখলের ক্ষেত্রে তা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেবল ২০১৬ সালেই ইরাকি সৈন্যদের প্রশিক্ষণ ও যন্ত্রাংশ সরবরাহে ১৬০ কোটি ডলার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সৈন্য ও বিমানবাহিনী মসুল দখলে জোটের অভিযানে বড় ধরনের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ইরাকে বেসামরিক সহায়তা হিসেবেও কোটি কোটি ডলার দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যেটাও সুনির্দিষ্টভাবে মসুলের জন্য প্রয়োজনীয়। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টার বলেছেন, তিনি এরই মধ্যে ইরাক পুনর্গঠনে সম্ভাব্য সহায়তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে ট্রাম্প মসুল অভিযানের সমালোচনা করেছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বলে আসছেন, বিদেশি সহায়তা কমাতে হবে। বিশেষ করে যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ঘৃণা করে’ বলে তিনি মনে করেছেন, সেসব দেশে সহায়তার পরিমাণ কমানোতেই নজর তার। ২০০৩ সালের ইরাক আগ্রাসন ও এর পরিণতি নিয়ে তার অসন্তোষ সম্ভবত ইরাককে তার কাছে এমন দেশের তালিকাতে স্থান দিয়েছে। বিপরীতে, হিলারি ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমর্থন অব্যাহত রাখবেন এবং তা বিস্তৃতও করবেন বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। কাজেই ইরাকের যারা মার্কিন নির্বাচনকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন, তারা সম্ভবত হিলারির বিজয়ের প্রত্যাশাই করছেন। এমনকি উত্তরের কুর্দিস্তানে রিপাবলিকানদের জনপ্রিয়তা বেশি থাকা সত্ত্বেও এ বছর ট্রাম্পের মতো ‘গোড়া ও অনিয়ন্ত্রণযোগ্য’ একজন প্রার্থীর প্রতি সমর্থন কমই থাকছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.