রাজধানীর পূর্ব কাজীপাড়ায় বহুতল ভবন ‘ব্লিজ রোদেলা’। এ ভবনের দ্বিতীয়তলার একটি ফ্ল্যাটে গড়ে তোলা হয় কংকাল প্রসেসিং কারখানা। কবর থেকে গলিত লাশ (ডি-কম্পোজড) উত্তোলনের পর একটি চক্র প্রসেসিং কারখানায় তা পৌঁছে দেয়।
প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল ব্যবহার করে গলিত এসব লাশ থেকে মাংস আলাদা করার পর তৈরি করা হয় কংকাল। পরে এসব কংকাল দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে মোটা অংকে বিক্রি করা হতো। দেশের বাইরেও পাচার হতো এসব কংকাল।
শনিবার রাতে গ্রেফতার ওই চক্রের মূল হোতা নূরুজ্জামান ওরফে কামরুজ্জামানকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
২০ থেকে ২৫ জনের একটি সিন্ডিকেট প্রায় এক বছর আগে ১৮৩/১ পূর্ব কাজীপাড়ার ওই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়ে কংকাল ব্যবসা শুরু করে। প্রতিটি গলিত লাশ তারা ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় কেনার পর প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে কংকাল তৈরি করে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করত।
জিজ্ঞাসাবাদে কামরুজ্জামান পুলিশকে বলেছে. বাংলাদেশে বিভিন্ন মেডিকেলের শিক্ষার্থী ছাড়াও দেশের বাইরেও তারা এসব কংকাল বিক্রি করত।
শনিবার রাতের ওই অভিযানে কাফরুল থানা পুলিশ ওই ফ্ল্যাট থেকে ৩২টি কংকাল ও ৮টি গলিত মানবদেহ উদ্ধার করে। এসব মানবদেহ বড় ড্রামের মধ্যে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামে শক্তিশালী কেমিক্যালে ডোবানো ছিল।
অভিযানের সময় উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ কেমিক্যাল (হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ও ব্লিচিং পাউডার)। তবে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। গ্রেফতার কামরুজ্জামানকে অন্য একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ।
পুলিশ জানতে পেরেছে, চক্রটি গলিত লাশের বেশির ভাগই ময়মনসিংহ এবং গাজীপুর এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন কবরস্থান থেকে সংগ্রহ করে। এসব এলাকায় গভীর বনে বিভিন্ন কবর থেকে লাশ তুলে বিক্রি করার জন্য আরেকটি চক্র রয়েছে।
গ্রেফতার কামরুজ্জামান পুলিশকে বলেছে, কেউ মারা গেলে কবর দেয়ার দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে তারা গলিত ওই লাশ সংগ্রহ করে ফেলে। এক থেকে দেড় সপ্তাহ পার হলে ওই মানবদেহ দিয়ে প্রকৃত কংকাল তৈরি সম্ভব হয় না। এটা লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় কবর থেকে গলিত লাশ সংগ্রহের জন্য তারা ওই এলাকায় কিছু কর্মীও নিয়োগ দিয়েছিল। গভীর রাতে এসব লাশ ঢাকার কাজীপাড়ার এ ফ্ল্যাটে এনে তা প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে কংকাল তৈরি করা হতো। পুলিশের মিরপুর বিভাগের
সহকারী কমিশনার (কাফরুল জোন) মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেছেন, কবর থেকে এত পরিমাণ গলিত লাশ উত্তোলনের তথ্য তাদের কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে। এ চক্রের সঙ্গে পেশাদার খুনি চক্রের যোগসাজশ আছে কিনা সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গ্রেফতারের পর নূরুজ্জামান ওরফে কামরুজ্জামন নিজেকে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র দাবি করলেও তার প্রমাণ এখনও দিতে পারেননি তিনি।
অবৈধ কংকাল ব্যবসা ও চাহিদা : ঢাকা মেডিকেল কলেজের এনাটমি বিভাগের একজন অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোববার যুগান্তরকে বলেছেন, দেশে বর্তমানে ২২টি সরকারি ও ৫৫টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর ৭ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হন। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে শতকরা ৬০ জন আগের ব্যাচে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কংকাল বা বোনস সংগ্রহ করে থাকেন। বাকি ৪০ ভাগ অর্থাৎ আড়াই হাজার শিক্ষার্থী প্রতি বছর বাজার থেকে নতুন বোনস বা কংকাল কিনে নেন। সে হিসাবে প্রতি বছর দেশে মেডিকেলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য কংকালের চাহিদা রয়েছে আড়াই থেকে তিন হাজার। মেডিকেল যন্ত্রাংশ বিক্রির বিভিন্ন বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাহিদার কথা জানিয়ে অগ্রিম টাকা দিলেই মেলে বোনস বা কংকাল।
তবে বাংলাদেশে বোনস বা কংকাল সংগ্রহে কোনো নীতিমালা না থাকায় নানা চক্র অবৈধ উপায়ে এ ব্যবসায় নেমেছে। বর্তমানে নিয়ম অনুযায়ী, শুধু বেওয়ারিশ লাশ কিংবা মৃত্যুর আগে কেউ তার দেহ দান করে গেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ওই লাশ থেকে কংকাল তৈরি করা হয়ে থাকে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.