এবারের পূজার ছুটিতে ভ্রমণ বাংলাদেশের সাথে ঘুরে এলাম খাগড়াছড়ি। এই ভ্রমণে আমরা ১৩ জনের একটি দল নিয়ে ঘুরে এলাম খাগড়াছড়ি আর রাঙ্গামাটির বেশ কয়েকটা পর্যটন এলাকায়। তিন দিনের এই ভ্রমনে রাতে ঘুমানোর সময় ছারা আর কোন বিশ্রাম থাকার কথা না। এতে অবশ্য আমার জন্য ভালই হবে। কারন, ঘুরতে বের হয়ে দিনের বেলা শোয়ে বসে থাকার লোক আমি নই। যতটুকু সময় পাওয়া যায় চারপাশ দেখে নেয়া চাই।
১৪ অক্টোবর রাত ১১টা ৪০ মিনিটে কমলাপুর থেকে সৌদীয়া পরিবহণে উঠে বসলাম। আমার সাথে উঠে এলেন খুকু আপা আর তার ছোট ভাই রনি। বাস চলতে শুরু করল। ঢাকার জ্যাম নিয়ে আর নতুন করে কিছু বলার নাই। বাসে উঠার কিছু পরেই ঘুম দিলাম। জ্যাম ঠেলে ঠুলে আমাদের বাস প্রায় ৩টার দিকে কুমিল্লার টাইম স্কয়ারে এসে থামল। ওয়াস রুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে সবাই মিলে মিড নাইট ডিনার সেরে আবার বাসে উঠে বসলাম। বাস আবার চলতে শুরু করেছে। এখন পথে আর জ্যাম দেখা যাচ্ছে না তেমন। বাসের জানালা খুলে দিলাম। আশ্বিনের এই শেষ দিনে শীতল বাতাসে কখন যে চোখে ঘুম চলে এলো বুঝতে পারিনি।
ঘুম যখন ভাংল তখন প্রায় সকাল হয়ে এসেছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। তার মাঝে মাঝে নীরব রোদের আলো মাঝে মাঝে উকি দিচ্ছে। বাসের সুপার ভাইজার এর কাছ থেকে জানতে পারলাম আর ঘন্টা খানেকের মাঝে আমরা খাগরাছড়ি শহরে পৌছে যাব। আমাদের বাস এখন ছুটে চলছে একটি চা বাগানের ভেতর দিয়ে। খাগরাছড়িতে যে চা পাতা চাষ হয় এটা আমার জানা ছিল না। দেখতে ভালই লাগছে সবুজের ভিতর দিয়ে যেতে।
ঘন্টা খানেক পরে আমাদের বাস খাগরাছড়ি শহরে এসে থামল। আমরা ১৩ জন যার যার ব্যাক-প্যাক নিয়ে পূর্ব নির্ধারিত হোটেলে গিয়ে উঠলাম। ব্যাক-প্যাক রেখে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে এলাম শহরের পথে। আমরা পাশের এক রেস্টুরেন্টে ব্রেক ফাস্ট শেরে নিলাম।
আমাদের প্রথম গন্তব্য খাগড়াছড়ির পর্যটন এলাকা আলু টিলা। খাগড়াছড়ির বাস টারমিনাল থেকে লোকাল বাসে করে ১৫ মিনিটের ভেতর চলে এলাম আলু টিলায়। গেট থেকে টিকেন কেটে ভিতরে চলে এলাম। অল্প একটু পথ পারি দিয়ে চলে এলাম আলু টিলার সবচেয়ে আর্কষনীয় স্থান গুহার কাছে। টর্চ আর কেরসিন তেলের তৈরি ছোট মশাল নিয়ে নেমে এলাম আলু টিলার গুহার মুখে। আমরা একে একে ভিতরে প্রবেশ করছি। একটু একটু ভয় লাগছে। আগে অনেক কাছে অনেক রকম গল্প শুনেছি এই গুহা নিয়ে। তাদের ভয় লাগার কথাও শুনেছি। চারদিক অন্ধকার মাথার উপর বাদুরের ঝুলে থাকা, হঠাৎ দু-একটা বাদুর চোখের সামনে দিয়ে উড়ে চলে যাওয়া, আবার অনেকের কাছে শুনেছি গুহার ভেতেরে প্রবাহমান পানিতে নাকি সাপ দেখেছে অনেকে। এ সব শুনে একটু ভয়ত হবেই। অন্ধকারে টর্চ আর মশালের আলোতে যখন বেশ কিছুটা পথ চলে এসেছি তখন ভয়টা কেমন যেন কেঁটে গেল। পায়ের নিচে পানি পরিমান খুব কম, মাথার উপরে বাদুরের ঝুলে থাকা নেই, নেই কোন সাপের ভয়। মনের ভেতর যে থ্রিলটা কাজ করছিল সেটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল? । গুহার বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করে আসার পরে ডান দিকে একটা সুরংগ বেকে গিয়েছে। ভাবলাম এই পথে হয়তবা আমার সেই থ্রিলটাকে খোঁজে পাব। তাই একা একা পা বারালাম বায়ের সুরংঙ্গে। কিন্তু সে আশা গুরে বালি। ঐ সুরংঙ্গ থেকে প্রধান সুরংঙ্গে ফিরে এলাম। সবাই সামনে এগিয়ে গেছে। আমিও আস্তে আস্তে এগিয়ে এলাম সামনের দিকে।
ঐত দূরে আলো দেখা যাচ্ছে। এখনি আমাদের বের হয়ে যেতে হবে ভেবেই মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল? । কিইবা আর করার আছে। এখানেত আর বসে থাকার ব্যাবস্থা নাই। সুরংঙ্গ মুখে এসে আলো ছায়া আর কুয়াশার খেলা দেখে মনটা ভেরে গেল। গুহার ভেতরে মন যতটা খারাপ হয়েছিল তার কয়েক গুন বেশি ভাল লাগল আমার। অন্তত যাদের হাতে ক্যামেরা ছিল তাদের মনের হাসি বলার মত না।
আমরা আলু টিলা থেকে বের হয়ে সামনের বিশাল বট গাছের নিচে এসে বসলাম। উপরে ছোট্ট একটু চা এর দোকান আছে। সেখানে আমাদের সবার জন্য চা এর অর্ডার দেওয়া হলো। চা শেষে আমরা একটা লোকাল বাসে উঠে বসলাম। রিছাং ঝর্ণা আলুটিলা থেকে আনুমানিক ৫ কি: মি: দূরে অবস্থিত। প্রথম ৩ কি.মি. পথ বাসে আসা গেলেও পরের ২ কি.মি. পাহাড়ি পথ আমাদের হেটেই যেতে হবে। অবশ্য যারা জীপ বা চান্দের গাড়ি নিয়ে এসেছে তারা এই পাহাড়ি ট্রেইলের ১ কি.মি. পর্যন্ত ভিতরে যেতে পারছে।
দুপুর হয়ে আসছে। মাথার উপর রোদটাও বেহায়ার মতো দাঁত বের করে হাসছে, আর গরমও পরেছে অনেক। মাঝে মাঝে পাহাড়ি জনবসতি, লোকজন এর দেখা পাওয়া যাচ্ছে। তাদের বিচিত্র জীবণ ধারা দেখে প্রতি বার অবাক হয়ে যাই। মেঠো জনপথ, পাহাড়ি পথের উঠা নামা সবুজ প্রকৃতী রোদরের খরতা আর দূরে পাহাড়ি নদীর বয়ে চলা দেখতে দেখতে কানে ভেসে এলো ঝর্ণা ধারার কল কল ধ্বনী। মনের ভেতর এক অজানা আনন্দ মাথাচারা দিয়ে উঠল। মুখে ফুটে এলো এক মায়াময় হাসি। হাসিটা শুধু আমার মুখে ছিল না, আমাদের দলের ১৩ জনের মুখেই ছিল এই হাসি। বিশেষ করে যারা এবার প্রথম পাহাড়ে বেড়াতে এসেছে।
আমরা নেমে এলাম রিছাং ঝর্ণার পাদ দেশে। ঝর্ণার পানি প্রায় ৩০ মিটার উপর থেকে ঝরে পরছে এক বিশাল আকৃতির হেলানো রকের উপর। এই রকের উপর দিয়ে পানি গরিয়ে পরার কারনে পুর এলাকা শ্যাওলা জমে আছে। শ্যাওলা জমে থাকার কারনে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পিচ্ছিল দেওয়া যায়। যদিওবা বিষয়টা বেশ ভয়ানক। যে কোন সময় বড় ধরণের দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই যতটা সম্ভব সতর্ক থাকা উচিত। এই পিচ্ছিল দেবার সময় আর একটা কমন দূর্ঘটনা ঘটে প্রায় সবার মাঝে আর সেটা হচ্ছে পাথরের উপর পিচ্ছিল দেবার বেশ কিছু স্থানে ধারালো হয়ে আছে। যার ফলে পিচ্ছল দেবার সময় প্যান্টের পিছরের অংশ ছিরে যায়, আর প্যান্টের সাথে সাথে :P। তাই সতর্কতার জন্য মোটা কাপরের প্যান্ট পরা উচিত।
ঝর্ণার পাশে আমাদের টেন্ট পাতা হল। এখানে আমাদের ব্যাক-প্যাক রেখে যার যার মতো উঠে এলাম হেলানো পাথরের উপর। একে একে আমরা পিচ্ছিল দিয়ে নিচে নেমে আসছি আবার উপরে উঠে আবার নেমে আসছি। এর মাঝে আমরা আমাদের প্যান্ট বিষর্জন দিয়ে ঝর্ণা থেকে উঠে এলাম।
হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ৩টার দিকে লাঞ্চ করার জন্য বের হলাম। লাঞ্চ শেষে শেষ বিকেলের আলোয় চলে এলাম নিউজিল্যান্ড পাড়ার চেংগি নদীর পারে। চমৎকার একটা বিকাল কাটালাম এখানে। আড্ডার ছলে সন্ধার পরের বেশ কিছু সময় এখানে কাটালাম। নদীর পারের ঠান্ডা বাতাসে ক্লান্ত শরীর নতুন করে অবকাশ খুজে নিতে চাইছে।
রাত প্রায় ৮টা বাজতে চলেছে। চারপাশ বেশ অন্ধকার হয়ে আছে। আর এর মাঝে কারেন্টের লুকচুরি চলছেই অনবরত। আমরা চেংগি নদীর তির থেকে উঠে এলাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম শহরের প্রাণ কেন্দ্র। শহরের পুজা মন্ডব গুলি বেশ মুখরিত হয়ে আছে পূর্ণাথীদের ভিরে। এই ভিরের মাঝে আমরার ভিরে গেলাম। আকাশে অনেক মেঘ জমেছে। চার পাশেই বিদুৎ এর ঝলকানি দিচ্ছে থেমে থেমে। এক সময় নেমে এলো বৃষ্টি। বৃষ্টির সাথে সাথে ঢাক-সাক বেজে চলেছে অবিরাম। আমরা বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় রইলাম। অনেকটা সময় পরে বৃষ্টি থেমে এলো। আমরা পুজা মন্ডব থেকে বের হয়ে রেস্টুরেন্ট এ গিয়ে ডিনার সেরে হোটেলে ফিরে এলাম।
বরাবরের মত ভোরে আমার ঘুম ভেংগে গেল। আমি আর হাসিব রুম শেয়ার করেছিলাম। আমার ঘুম থেকে উঠা দেখে সেউ উঠে পরল। আমি আর হাসিব রুম থেকে বের হয়ে চলে এলাম নিউজিল্যান্ড পাড়ায়। গতকাল সন্ধাটা যেখানে ছিলাম ঠিক সে জায়গাতেই। সম্পূর্ণ এলাকা যেন মেঘের চাদরে ঢেকে আছে। শিশির ভেজো ভোরে ঐ দূরের ফসলের সমতল মাঠে এক দল কৃষাণি কাজ করে চলেছে অবিরাম। চেংগি নদীতে এক দল শিশু ছোট জালে মাছ ধরছে। হাসিবকে নদীর এক কিনারায় বসিয়ে আমি ক্যামেরা নিয়ে নেমে এলাম নদীর পার ধরে অন্য কিনারায়
এর মাঝে কখন যেন আমাদের হোটেলে ফিরে যাবার সময় হয়েগেয়েছিল খেয়াল করিনি। হাসিব আমাকে দু’বার ডাক দিল। আমি উত্তর নিয়ে উপরে উঠে এলাম। কিন্তু উপরে উঠে হাসিবের কোন দেখা পেলাম না। আর ওর মোবাইল নাম্বারটাও আমার কাছে নাই। ওকে খুঁজতে একবার এদিক যাই আবার ওদিক যাই, কোথাও নাই। হোটেলে মনা ভাইকে ফোন দিয়ে জানালাম ঘটনাটা। আমি ফোন দেবার ১৫ মিনিট পরে মনা ভাই ফোন করে জানাল হাসিব হোটেলে ফিরে এসেছে। আমিও ফিরে এলাম হোটেলে। হোটেলে এসে হাসিবকে একটু ঝারি দিলাম। এভাবে কি কেউ চলে আসে….।
সকালের নাস্তা সেরে চান্দের গাড়িতে চেপে আমাদের যাত্রা শুরু হলো দেবতার পুকুরে। আজ আমাদের সাথে ঢাকা থেকে আসা আরেকটি দলের যোগ হবার কথা। তাদের জন্য আমাদের চান্দের গাড়ি চলে এলো আলো টিলা পর্যটন এলাকায়। এখান থেকে তাদের নিয়ে আমাদের চান্দের গাড়ি ছুটে চলল উচু নিচু আকা বাকা পাহাড়ি পথে। অনেকটা পথ পারি দিয়ে আসার পরে চান্দের গাড়ি পিচ ঢালা পথ থেকে নেমে ইট বিছানো পথে নেমে গেল। এই পথ যেন আরও আকা বাকা ঢালু। একটু পরেই চান্দের গাড়ির পাইলট জানাল গাড়ির পথ শেষ, গাড়ি আর সামনে যাবে না। আমরা ব্যাক-প্যাক নিয়ে নেমে এলাম পথে। বেশ কিছুটা পথ চরাই উতরাই করে নেমে এলাম এক ঝিড়িতে। ঠান্ডা পানিতে পা ভেজাতেই সারা শরীরে শান্তি নেমে এলো। ঝিরি পথ থেকে উঠে এলাম এক বাধানো পাকা সিরি বেয়ে উপরে। এখন আবার শুরু হল সেই চরাই উতরাই। গাছ গাছালির জন্য রোদের আলো তেমন পরছে না। পাহাড়ের একেবারে উপরে উঠে এলে ঠান্ডা বাতাসে শরীরের ক্লান্তি ভাবটা আবার কমতে শুরু করে।
এভাবে ঘন্টা খানেক হাঁটবার পরে আমরা নিজেদেরকে দেবতার পুকুরের পাশে আবিস্কার করলাম। বেশ ভাল লাগল পরিবেশটা। শীতে যদি এখানে ক্যাম্প ফায়ার করা যায় তবে অনন্দটা আজকের থেকে কয়েকগুণ বেরে যাবে। পুকুরের ঠান্ডা পানিতে নেমে গোসল করে উঠে এলাম। কিছু সময়ের মাঝে আমরা আবার ফিরতি পথে হাঁটা দিলাম। এর পর চান্দের গাড়িতে চেপে আবার ফিরে এলাম শহরে। চান্দের গাড়ির এই জার্নিতে আমাদের শরীরের নাট-বল্টু সব নরবরে হয়ে গেছে? ।
আজ দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিতে হলো সিস্টেমে? । লাঞ্চ শেষে হোটেলে গিয়ে তারাহুরু করে ব্যাক-প্যাক নিয়ে বের হয়ে এলাম খাগড়াছড়ি বাস টারমিনালে। আজ আমরা খাগড়াছড়ি ছেরে চলে যাব মারিশ্যা। মারিশ্যাতে সরকারি ডাকবাংলতে আমাদের থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। এখানে আজ রাতে থেকে পরদিন সকালে আমরা মারিশ্যা থেকে লঞ্চে করে শুভলং হয়ে রাঙ্গামাটি চলে যাব, আর রাতের গাড়িতে ঢাকা।
আকাশে অনেক মেঘ জমেছে। যে কোন সময় বৃষ্টি নেমে আসতে পারে। এর মাঝে সন্ধা ৭টার দিকে আমাদের বাসটি এসে থামল মারিশ্যা বাজারে। বাস থেকে নেমে দেখলাম গুরিগুরি বৃষ্টি হচ্ছে। ব্যাক-প্যাক নিয়ে সকলে এক লাইনে হেটে চলে এলাম ডাকবাংলয়। বাংলয় এসে ব্যাক-প্যাক রেখে একটু বিশ্রাম নিলাম। এলাকার কোথাও কোন কারেন্টের দেখা পেলাম না। পাশের বাজারে জেনারেটর চলার শব্দ ভেসে আসছে আর অদূরের কোন এক পূজা মন্ডব থেকে ঢোলের শব্দ ভেসে আসছে। আর এর মাঝে বৃষ্টি দেবী যেন তার বৃষ্টির থলে উপুর করে দিলেন পৃথিবীর দিকে। ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল। আমি আর রুমে বসে থাকতে পারলাম না। এক দৌড়ে চলে এলাম বৃষ্টির নিচে। আহ্ কি শান্তি। কতো দিন যে এভাবে ভেজা হয় না। শেষ কবে যে ভিজেছিলাম মনে পরছে না। এক বন্ধুকে বৃষ্টিতে ভিজতে মানা করি সব সময়। তার কথা মনে পরছে খুব।
১০টা বাজতে চলেছে, এখনো বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে না। ক্ষুধার যন্ত্রনায় আর যে বসে থাকা যাচ্ছে না। রেইন কোট আর ছাতা নিয়ে সবাই রেডি হয়ে গেল। আমার ছাতাটি আনা হয়নি? । খুকু আপা দুটা ছাতা নিয়ে এসেছে। আমাকে একটা দিলেন। এই ছাতাটা নাকি তার চাকরি জীবনের শুরু থেকে তার কাছে আছে। আর এই চাকরি জীবনের বর্তমান বয়স মাত্র ১০ বছর।
মারিশ্যা বাজারের হোটেলে খাবারটা ভালই ছিল। ভাত সবজি আর দেশি মুরগির ঝোল। পেট পুরে খেয়ে নিলাম সবাই। ভাত খাওয়া শেষে পেলাম গরম গরম রসগোল্লা। ৩ কেজি রসগোল্লা নিয়ে আমরা ফিরে এলাম আমাদের বাংলয়। বাংলর সবচেয়ে বড় রুমটাতে রস গোল্লাকে কেন্দ্র করে সবাই বসে পরলাম। এক এক করে শুরু হলো আমাদের এই ভ্রমণের ভাল আর মন্দ লাগার অভিজ্ঞতার বর্ণনা।একে একে বের হয়ে এলো আমাদের ভাল আর খারাপের দিক গুলি। প্রায় ঘন্টা খানেক চলল আমাদের এই মত বিনিময়। এর পরে রস গোল্লা খেয়ে ইতি টানা হলো আজকের দিনের কর্ম সূচি। একে এক সবাই চলে গেলাম ঘুমের দেশে।
মেঘে ঢাকা ভোরে হাঁটতে বেরহলাম আমি, ফেরদৌস ভাই, রাকিব ভাই আর হাসিব। নদী পাড়ে হাটতে ভালই লাগছিল। দূর পাহাড়ের উপর দিয়ে সূর্যের উঠে আসা দেখতে বেশ ভালই লাগল। আধ ঘন্টা পর ফিরে এলাম। ফিরে দেখি মৌরী’পু মোবাইল হাতে নিয়ে বাইরের উঠানে বসে আছে। আজ ওনার বরের আসার কথা দীঘিনালা থেকে। প্ল্যান ছিল সকালের লঞ্চে আমরা এক সাথে মারিশ্যা থেকে সুভলং যাব। কিন্তু তার বরের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মোবাইল বন্ধ নাকি নেটওয়ার্ক প্রবলেম ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। মারিশ্যায় শুধু টেলিটকের নেট পাওয়া যাচ্ছে।
৭টা বাজতে চলেছে। এবার আমাদের ছুটতে হবে লঞ্চ ঘাটে। ফ্রেশ হয়ে ব্যাক-প্যাক গুছিয়ে হাঁটা দিলাম লঞ্চ ঘাটের দিকে। লঞ্চের দুতালায় আমাদের জন্য সিট নেয় হয়েছে। মৌরী’পু বর এখনও এলো না। তবে মোবাইলে কন্ট্রাক করতে পেরেছে। তার বর মটর সাইকেলে দীঘিনালা থেকে রওনা হয়েছেন। ঘন্টা খানেক বাদেই সে মারিশ্যা চলে আসবেন। কিন্তু এতক্ষনে যে আমাদের লঞ্চ চলে যাবে। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আমরা এই লঞ্চেই চলে যাব। শুধু মৌরী’পু কে এখানে রেখে যাব। পরের লঞ্চে তিনি আর তার বর চলে আসবেন। আমরা লঞ্চে উঠে পরলাম। ব্যাগ-প্যাক সিটের উপর রেখে আমরা লঞ্চের ছাদে উঠে এলাম। সিটে বসে রইলেন মুন্না ভাই, রাকিব ভাই, খুকু আপা আর তুহিন আপা।
লঞ্চে উঠে আফজাল ভাই শুরু করলেন গান। তার গানের সুরে ভেসে যেতে থাকলাম আমরা। এর মাঝে কখন যে কয়েক ঘন্টা পার হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। বেশ কয়েক ঘন্টার জার্নি শেষে আমরা নেমে এলাম সুভলং এর আর্মি ক্যাম্প ঘাটে। ব্যাক-প্যাক নারেকেল গাছের ছায়ায় রেখে আমরা ছুটলাম বাংলাদেশের সবচেয়ে উচু পুলিশ ক্যাম্প এর দিকে।
পুলিশ ক্যামপের দিকে আমরা পা বাড়িয়েছি ৬ জন। কিছু পথ উপরে উঠার পর খুকু আপা আর তুহিন আপা বসে পরলেন। তারা আর উপরে উঠবেন না বলে জানালের। বাকিরা আস্তে আস্তে উপরে উঠতে শুরু করে দিলাম। যত উপরে উঠছি ট্রেইল যেন আরও বেশি খারা হতে থাকল। খেয়াল করে দেখলাম কারও সাথেই পানি আনা হয়নি। পরলাম মহা ফ্যাছাদে। এদিকে যে এক এক জনের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। আমার প্যান্ট এর পকেট হাতরে পেলাম কিছু আমলকি যা ছিল ক্যামেরার ব্যাগে। লঞ্চে ক্যামেরার ব্যাগ থেকে বের করে প্যান্টের পকেটে রেখেছিলাম। দু’টা করে ৪ জনের মাঝে ভাগ করে নিয়ে মুখে দিলাম আমলকি। পানির তৃষনা অনেকটাই চলে গেল আমলকির রসে। আমরা আবার উঠতে শুরু করলাম। আছতে আছতে এক সময় উঠে এলাম পাহাড়ের উপরে পুলিশ ক্যাম্পে। উপরে উঠে দুই লিটার পানি কিনে নিলাম। পানি খেয়ে যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলাম তখন মনা ভাই উঠে এলেন উপরে। চার পাশের সবচেয়ে উচু পাহড় এটি। তাই সুভলং এর চার পাশ যেন চোখের সামনে চলে এসেছে। এই পুলিশ ক্যাম্প বাংলাদেশের সবচেয়ে উপরে অবস্থিত। সী লেভেল থেকে এর উচ্চতা প্রায় ১৮৬০ ফুট (সূত্র: ক্যাম্পের পুলিশ)।
বেশ কিছু সময় উপরে কাটিয়ে আমরা নেমে এলাম নিচে। এদিকে মৌরী’পু ফোনে জানালেন সুভলং এ তার লঞ্চ এসে পৌছাতে আর আধ ঘন্টার মত সময় লাগবে। আমরা তার লঞ্চে করেই রাঙ্গামাটি চলে যাব। তাই তারাহুর করে এক রেস্টুরেন্টে চিকেন ফ্রাই আর কোক-ফান্টা র ককটেল দিলে লাঞ্চ করে নিলাম।
মৌরী’পুর লঞ্চ আর্মি ক্যাম্প ঘাটে থেমেছে। বেশ কিছু যাত্রি নেমে এলো লঞ্চ থেকে। শুধু উঠে এলাম আমরা। লঞ্চ চলতে শুরু করেছে আবার। চলতি পথে বেশ কিছু ঝর্ণার দেখা পেলাম পাহাড়ের গায়ে। সুভলং এর বড় ঝর্ণাটা দেখে বেশ ব্যাধিত হলাম। পানি ঝরে পরার পরিমান এত কম যে কদিন পরে আর পানির দেখাও পাওয়া যাবে না? ।
রাঙ্গামাটির ঘাটে লঞ্চ থেমেছে। আমরা ব্যাক-প্যাক নিয়ে হেটে হেটে চলে এলাম বাস কাউন্টারে। উইনিক পরিবহনের ওয়েটিং রুমে আমাদের ব্যাক-প্যাক রেখে সবাই বিশ্রাম নিতে ফ্যান এর নিচে বসে পরলাম। আর মনা ভাই ছুটলেন আমাদের ফ্রেশ হবার ব্যাবস্থা করতে। আমাদের বাস ৯টায়, এখনও বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়নি। তাই আমি ছুটলাম রাঙ্গামাটি পর্যটনের ঝুলন্ত ব্রীজ দেখতে। আমার সংঙ্গি হলেন রাকিব ভাই, হাসিব, মৌরী’পু ও তার বর।
ব্রীজের টিকেট বুথ থেকে ফিরে এলাম মুখ ভার করে। ওরা জানাল লেকের পানিতে ব্রীজটি ডুবে যাবার করনে এখন ভিতরে যেতে দিচ্ছে না পর্যটক দের। অবশ্য এখানে প্রবেশের আগে বেশ কয়েক জন সাম্পান’লা ডেকেছিল লেকে ঘুরে দেখাবে বলে। আমরা এখন ছুটলাম তাদের কাছে। ১০০ টাকায় রফা করে একটি সাম্পান ছুটল আমাদের ৫ জনকে নিয়ে।
আধ ঘন্টা ঘুরে আবার ফিরে চললাম বাস কাউন্টারের দিকে। মনা ভাই এদিকে আমাদের গোসলের জন্য হোটেলের একটি রুম ঠিক করে ফেলেছেন। ওয়েটিং রুমে মোবাইল ও ক্যামেরা চার্জে দিয়ে আমরা ছুটলাম গোসল করতে।
গোসল শেষে ওয়েটিং রুমে এসে বসলাম কিছু সময়। ৮টার দিকে রুপ চাদা মাছ দিয়ে ডিনার সেরে ধূয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম ঢাকায় ফিরে আসার বাসের জন্য।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.