বিবাহের অরুণোদয় হইল একখানি ফটোগ্রাফের আভাসে। পড়া মুখস্থ করিতেছিলাম। একজন ঠাট্টার সম্পর্কের আত্মীয়া আমার টেবিলের উপরে ছবিখানি রাখিয়া বলিলেন, ‘এইবার সত্যিকার পড়া পড়ো—একেবারে ঘাড়মোড় ভাঙিয়া।’ (হৈমন্তী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) রবীন্দ্রনাথের গল্পের মতো এ যুগে কেবল ফটোগ্রাফ দেখে আর সম্বন্ধ করে বিয়ে? পরস্পরকে কিছুমাত্র না জেনে-শুনে? প্রায় অসম্ভবই বলতে হবে। এমনকি পারিবারিক সম্বন্ধ করেও যেসব বিয়ে হয় এখনকার দিনে, তাতেও বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীকে চেনাজানার সুযোগ দেওয়া হয়। কথাবার্তা কিছু হয়, জানাশোনা হয়। দেখা-সাক্ষাৎও হয়। কিন্তু প্রেম-পরিচয়ের বিয়েতে দুজনের মাঝে যে রসায়ন থাকে, সম্বন্ধ করে বিয়েতে সেই রসায়ন কি তৈরি হওয়ার সুযোগ আছে? নাকি প্রাত্যহিকতার কারণে এই একসঙ্গে থাকা, ভালোবাসাবাসি একটা নিতান্ত দৈনন্দিন অভ্যাসের মতো গড়ে ওঠে? বিয়ের পরে দুজনের মধ্যে সহাবস্থান বা সহমর্মিতা শুধু নয়, পুরোদস্তুর প্রেমও কি হয়ে উঠতে পারে? বয়স্ক ব্যক্তিরা এ ক্ষেত্রে নিজেদের উদাহরণই টানবেন। আমাদের মুরব্বি স্থানীয়দের অনেকের বাসর রাতেই হয়তো প্রথম স্বামী-স্ত্রীর সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাতে প্রেম-ভালোবাসার কমতি পড়েছিল কি কিছু? কিন্তু তাঁদের বুঝতে হবে এই সময়টা সেই সময় নয়। অচেনা-অজানা কাউকে চট করে ভালোবেসে ফেলা, প্রেমে পড়া আজকালকার দিনে একটু বিদঘুটেই শোনায়। কিন্তু তাই বলে কি সম্বন্ধ করে বিয়ে হচ্ছে না? আর অ্যারেঞ্জড ম্যারেজেও কি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেমময় সম্পর্ক গড়ে উঠছে না? হ্যাঁ, হতেই পারে। হয়ও। বিয়ের আগে কেউ কাউকে জানতেন না, অথচ বিয়ের পর এখন একে অপরকে রেখে এক মুহূর্তও থাকতে পারেন না—এমন দম্পতি অনেক দেখেছি। সম্বন্ধের বিয়েতেও প্রেমিক-প্রেমিকার মতোই স্বামী-স্ত্রীরা মান-অভিমান, সন্দেহ-দোলাচল, অনিশ্চয়তা-উচ্ছ্বাস এমন বিচিত্র অনুভূতির মধ্য দিয়ে যান ও সম্পর্কটাকে অবশেষে গড়ে তোলেন। বর্তমান কালের নিউক্লিয়ার পরিবারে তা ছাড়া সম্ভবও নয়। টোনাটুনির সংসারে প্রেম না থাকলে কি চলে? তবে বিয়ের পরের প্রেমটা ঝোড়ো হাওয়ার মতো উথালপাথাল নয়, বরং হালকা হাওয়ার মতো। ধীরে ধীরে হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। এর মধ্যে পাগলামির ব্যাপারটা হয়তো থাকে না, কিন্তু একটা স্থির-ধীর সৌন্দর্য থাকে, থাকে ‘হয়ে ওঠা’র গল্প। রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটা দিয়েই শেষ করি। ‘দানের মন্ত্রে স্ত্রীকে যেটুকু পাওয়া যায় তাহাতে সংসার চলে, কিন্তু পনেরো আনা বাকি থাকিয়া যায়।’ কথাটা হয়তো ততখানি ঠিক নয়। সংসার চালানো ছাড়াও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুর মতো, সহচরের মতো, প্রেমিক-প্রেমিকার মতো সম্পর্ক গড়ে ওঠা এখন আর বিচিত্র নয়। অসম্ভব নয় বিয়ের পরেও প্রেমে পড়া, প্রেমে মশগুল হওয়া। ষোলো আনা ভালোবাসাবাসি হয়তো বিয়ের পরেও আরম্ভ করা যায়।
এই ভালোবাসার ভিতটা মজবুত সত্যিকার অর্থে পারিবারিক সম্বন্ধ করে বিয়ে যাকে বলে, তেমনটাই হয়েছিল চৈতি-মিলটন দম্পতির জীবনে। ২০১০ সালে পরিচিত একজনের মধ্যস্থতার মাধ্যমে দুই পরিবারের কথাবার্তার ফলস্বরূপ বিয়ে হয় তাঁদের। ‘এমনকি আজকালকার যুগে যা হয়, বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার পর দুজনে একটু কথাবার্তা বলে বা ঘোরাফেরা করে, আমাদের তাও হয়নি’—হাসতে হাসতেই বললেন চৈতি। ‘সে-ও কেন যেন খুব একটা ফোনটোন করত না, আমি তো না-ই। আর দেখা-সাক্ষাৎ? তাও না। বলতে গেলে বিয়ের পরই আমাদের জানাশোনার শুরু।’ এতে করে পরস্পরের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা-হৃদয়ের টান গড়ে উঠতে সমস্যা হয়েছে কিছু? উত্তরে একটু ভেবে বলেন চৈতি, ‘প্রথম প্রথম একটু ভয় করত বৈকি। ওর পছন্দ-অপছন্দ কিছুই তো জানা নেই। ওর লাইফস্টাইল, চালচলন, ওদের বাড়ির নিয়মকানুন। কিসে আবার কী মনে করে বসে! কোনটা আবার অপছন্দ হয়! আগে থেকে একটু জানাশোনা থাকলে হয়তো এই টেনশন আর ভীতি একটু কম কাজ করে। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজে তাই প্রেম-ভালোবাসা গড়ে উঠতে একটু দেরি হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে হয় বলেই হয়তো তার ভিতটাও মজবুত। আস্তে আস্তে প্রতিদিন একটু একটু করে জানা, বোঝা, ভালো লাগা, একসঙ্গে থাকা—এই ভাবে একদিন ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে যায়। এটাই হয়তো প্রেম।’
সত্যি ‘মেড ফর ইচ আদার’ খুব ঘুরতে ভালোবাসেন আশরাফ। ঘুরে বেড়ানো, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, হইচই তাঁর পছন্দ। এই মানুষটিরই প্রেমে পড়েছেন টুম্পা। এক দিনে নয়, দিনে দিনে, ধীরে ধীরে। আশরাফও তাই। দুজনের একসঙ্গে দারুণ দারুণ জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর, উড়ে বেড়ানোর ছবিগুলো সেই কথাই বলে। অথচ চিকিৎসক আশরাফ ও চিকিৎসক টুম্পার বিয়েটাও পারিবারিকভাবেই হয়েছিল। আশরাফের শিক্ষক বিয়ের সম্বন্ধটা এনেছিলেন, বিষয়টা মোটেও আমলে না নিয়ে এর মধ্যেই আশরাফ বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে চলে গিয়েছিলেন লাদাখ। ফিরে এসে শোনেন বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক। বলতে গেলে বিয়ের আগে তাঁদের মধ্যে তেমন করে জানাশোনাই হয়নি। ‘তাতে অবশ্য কোনো সমস্যা হয়েছে বলে মনে হয় না’, বলেন আশরাফ। বিয়ের পরই তাঁদের ভালো লাগা আর ভালোবাসার শুরু। আর তাতে আবেগ-উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না মোটেও। ‘এখন তো মনে হয় আমরা সত্যি সত্যি মেড ফর ইচ আদার।’ টুম্পাও বলেন, ‘একেবারে অচেনা-অজানা একজনকে জানতে-বুঝতে কয়েক মাস সময় তো লেগেই যায়। তবে বিয়ের পরের প্রেমে সুবিধে হলো এই যে এতে আগের মানুষটির সঙ্গে তুলনা করার ব্যাপার নেই। বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই, যারা প্রেম করে বিয়ে করেছে, তাদের বলতে শুনি বিয়ের আগের প্রেমিক বা প্রেমিকাটিকে বিয়ের পর অমন করে খুঁজে পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে সেই আফসোসের কোনো জায়গা নেই। আমরা যেমন, মানে যেভাবে পরস্পরকে পেয়েছি, সেভাবেই পরস্পরকে ভালোবেসেছি। নিজেদের ভালো, মন্দ, পার্থক্য, তফাত—সব মিলিয়েই এই ভালোবাসা গড়ে উঠেছে।’ এ মাসেই তাঁদের বিয়ের পাঁচ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। সংসারে এসেছে নতুন অতিথিও। কিন্তু তাঁরা দুজন, তাঁদের মতে, এখনো পরস্পরের প্রেমেই মজে আছেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.