রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে যে আলোচনা হলো

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে এর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব, পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রথমে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। পাওয়ার সেলের পক্ষ থেকে ২০০১-২০০৭ সালের বিদ্যুতের করুণ অবস্থা তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে তিনি জানান, বর্তমান বিশ্বে কয়লা থেকে পোল্যান্ড ৯৮ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ৯৩ শতাংশ, ভারত ৭৩ শতাংশ, জার্মানি ৪৬ শতাংশ, আমেরিকা ৪০ শতাংশ, চীন ৭৮ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। যেখানে বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হার ৩ শতাংশের কম। রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনের পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে বেশ কয়েকটি সংস্থা ও ব্যক্তিরা মতামত তুলে ধরছেন। কিন্তু সুন্দরবনের পরিবেশের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সে জন্য সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার, ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হবে। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার জানান, চুক্তিটি সম্পূর্ণ সুষম আন্তর্জাতিক চুক্তি। একই সঙ্গে প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হলে সুন্দরবনসহ আশপাশে পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার  কোনো সম্ভাবনা নেই।
তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ বলেছেন, এর আগে কনকোফিলিপসের সঙ্গে অসম চুক্তি না করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার সেই অসম চুক্তি করেছিল। ফলে কনকোফিলিপস প্রায় দীর্ঘ ৭ বছর অতিবাহিত করে কোনো গ্যাস সরবরাহ না করে চলে যায়। এর ফলে আজকে দেশে গ্যাসসহ অন্যান্য জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে নিয়ে সুন্দরবনের আশপাশে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় জমি দখলসহ প্রায় ১৫০টির মতো বাণিজ্যিক বলয় গড়ে উঠতে যাচ্ছে। এগুলো সুন্দরবনকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
প্রসঙ্গক্রমে তিনি আরো বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় নিয়ে এলে এক পর্যায়ে সভাপতি তার বক্তব্য সুন্দরবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার অনুরোধ জানান। এ সময় আনু মুহাম্মদ বলেন, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে যে বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয়েছে তার আলোকে বক্তব্য রাখা হয়েছে। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের যে ক্ষতি করে তার ওপর জাতীয় কমিটিসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন রয়েছে। বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, মাটি দূষণের মাধ্যমে সুন্দরবনের খাদ্য চক্র, জীবন চক্র ও বনের সমগ্র ইকো সিস্টেমকে বিপর্যস্ত করার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবন ক্ষতির জন্য যে উপাদানগুলো তৈরি হচ্ছে এর থেকে রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে তা দিয়ে নিশ্চিত করা যাবে না। তিনি নিশ্চিতভাবে বলেন, শেষ পর্যন্ত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎও পাওয়া যাবে না। কিন্তু সুন্দরবনের ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে।
ক্যাবের উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, সুন্দরবন যদি সুরক্ষা না হয় তাহলে রামপাল প্লান্ট হবে না। সুন্দরবন সুরক্ষা হলে রামপাল প্লান্ট হবে। সেটি ছাড়াই চুক্তি হয়ে গেল।
বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, রামপাল সম্পর্কে কোম্পানি যে পরিবেশ মূল্যায়ন প্রতিবেদন দিয়েছে সেটাই পরিবেশ অধিদফতর অনুমোদন করেছে। এ রকমভাবে ফুলবাড়িয়া কয়লা খনি উš§ুক্তভাবে উত্তোলনের বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর অনুমোদন দিয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে গণরোষের মুখে আর নবায়ন করা হবে না। নিরপেক্ষ সংস্থা বা বিশেষজ্ঞ নিয়ে মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে যদি বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে কারো কিছু বলার থাকবে না। তবে যারা এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে তাদের মধ্যে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ কেউ নেই। তিনি বলেন, এখানে কোনো বন বা দূরত্ব নিয়ে কথা নয়। কথা হচ্ছে সুন্দরবন নিয়ে, সুন্দরবনের অস্তিত্ব নিয়ে। উপস্থাপনায় বলা হয়েছে সুন্দরবনের এরিয়া কমে যাচ্ছে। তাহলে পরিবেশ অধিদফতর আইন অনুয়ায়ী সুন্দরবন রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না কেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, যদি সুন্দরবনের ভেতর বা আশপাশ দিয়ে এভাবে জাহাজ চলাচল করে তাহলে বাঘের জেনেটিক ক্যারেকটারের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। সুন্দরবনকে যেভাবে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ ভুলভাবে করা হচ্ছে। সুন্দরবনকে শুধু সুন্দরবনের বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে যেভাবে সহজ ভাষায় বলা হচ্ছে কোনো ক্ষতি হবে না, তা আসলে ঠিক নয়। বিজ্ঞানভিত্তিক যে তথ্য রয়েছে তাতে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুন্দরবন যদি ক্ষতি হয় তাহলে সকল দায়-দায়িত্ব আমাদের ওপর পড়বে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে সুন্দরবন ধ্বংস হোক তা আমরা চাই না। রামপালে না করে পশুর নদী ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও সরিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে কোনো জটিলতা ছাড়াই সরকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম. নেয়ামুল নাসের বলেন, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ঘিরে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ শিল্প প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোনো সেল নাই।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. কাজী বায়েজীদ কবির বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ক্ষতি হবে কি হবে না তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে ১৯৯৭ সালে ডব্লিউএইচওসহ অনেক গাইড লাইন রয়েছে। তবে তিনি পানি প্রবাহ, তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে বলেন, প্লান্টটিতে ব্যবহার করা প্রযুক্তি, বায়ু প্রবাহের দিক, ব্যবহার করা বয়লার ও কয়লা এসব একত্র করে দেখা হলে বলা যায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না।
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব বলেন, সুন্দরবনে যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সে দিকে সরকার পুরোপুরি সজাগ। এর পরও প্রকল্পটি সব কার্যক্রমে ওপেন মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পরিবেশের ক্ষতি না করেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
এমপি বেগম নাসিমা ফেরদৌসি বলেন, প্রকল্পের অবস্থান সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে। সুতরাং সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যায়। এমপি মো. আবু জাহির বলেন, আমন্ত্রিত অতিথিদের বক্তব্যে উভয়ের মধ্যে দূরত্ব অনেকটা কমে আসছে। বর্তমান সরকার সুন্দরবনের ক্ষতি হবে তা আশা করে না। এমপি মো. আতিউর রহমান আতিক বলেন, সবাই মিলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। যে সিদ্ধান্ত আমাদের দেশকে সামনের দিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে। এমপি আ ফ ম বাহাউদ্দিন (নাছিম) বলেন, শুধু সুন্দরবন নয় দেশকে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তিনি আশা করেন আমন্ত্রিত অতিথিরা জাতির জনকের সেই স্বপ্নের সেই সারথী হিসেবে থাকবেন।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। জাপানের ইয়োকোহামাতে ও জার্মানির রাইন নদীর তীরে এ ধরনের পাওয়ার প্ল্যান্ট সরেজমিনে পরিদর্শনের পরেই নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, রামপালে ওই ধরনের কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট করা যায়। আমাদের এখন মিশন ভিশন হচ্ছে চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎ হবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ।
সভাপতির ভাষণে মো. তাজুল ইসলাম এমপি বলেন, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ এখন ব্যয়সাধ্য। বাংলাদেশে খুব বেশি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ নেই। সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ যথেষ্ট পরিমাণ ব্যবস্থা নিয়েছে। উন্নত প্রযুক্তি ও প্রয়োজনীয় সতর্কতার মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবনের ও পশুর নদীর ক্ষতি হবে না।