আইনশৃংখলা বাহিনীর জন্য এক চমৎকার নীতিমালা তৈরি করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। ১৯ দফা নির্দেশনাসংবলিত নীতিমালার ছত্রে ছত্রে রয়েছে মানবাধিকারের ছাপ। বলা হয়েছে, গ্রেফতারের সময় আইনশৃংখলা বাহিনীকে পরিচয়পত্র দেখাতে হবে এবং কাউকে গ্রেফতারের পর সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টার মধ্যে তার আত্মীয়স্বজনদের জানাতে হবে গ্রেফতারের কথা এবং একটি ডায়েরিতে গ্রেফতারের সময় থেকে যাবতীয় তথ্য নথিভুক্ত করতে হবে, সেখানে থাকতে হবে আটককৃত ব্যক্তির স্বাক্ষর। নির্দেশনা অনুযায়ী একসঙ্গে ১৫ দিনের বেশি গ্রেফতারকৃতকে রিমান্ডে নেয়া যাবে না এবং কেস ডায়েরি ছাড়া তাকে আদালতে উপস্থাপন করা হলে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে মুক্তি দেবেন। বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকের জন্য ৫৪ ধারার প্রয়োগ করা যাবে না মর্মেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগের নির্দেশনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্বস্তিদায়ক অংশটি হল, আটক ব্যক্তি হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মর্মে মেডিকেল রিপোর্ট পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ নেবেন বিচারিক আদালত। আপিল বিভাগের ১৯ দফা নির্দেশনার ১০টি আইনশৃংখলা বাহিনীর এবং বাকি ৯টি হাকিম, বিচারক ও ট্রাইব্যুনালের জন্য প্রযোজ্য। আমাদের দৃষ্টিতে প্রতিটি নির্দেশনাই যুক্তিসঙ্গত এবং মানবাধিকার সুরক্ষার কবচ। আমরা দীর্ঘদিন থেকে লক্ষ্য করে আসছি, আইনশৃংখলা বাহিনী অসংখ্য ক্ষেত্রে মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ করছে। হয়রানিমূলক গ্রেফতার থেকে শুরু করে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে অনেক, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারার অপপ্রয়োগ হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, গ্রেফতারের কারণসহ ঘটনাপ্রবাহ ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করার বিধান না থাকায় আটককৃত ব্যক্তির সঙ্গে খেয়াল-খুশিমতো আচরণ করার সুযোগ থাকছে। আমরা এমনও দেখেছি, পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়া হলেও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা কাউকে গ্রেফতারের সময় তা দেখাননি। ফলে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন অনেক সময় জানতেও পারেননি তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আবার পরিচয়পত্র দেখানোর চল না থাকায় আইনশৃংখলা বাহিনীর পরিচয়ে দুর্বৃত্তরা তাদের টার্গেটকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। রিমান্ড ও রিমান্ডে নির্যাতনও আমাদের কম দেখতে হয়নি। এককথায় বলতে গেলে, গ্রেফতার ও মামলা দায়ের প্রক্রিয়ায় অনানুষ্ঠানিকভাবে এমন কিছু ঘটে চলেছে, যার অনেক কিছুই পরবর্তীকালে চ্যালেঞ্জ করা যাচ্ছে না যেমন, তেমনি আটককৃত ব্যক্তি মানবাধিকারসম্মত আইনি সহায়তাও পাচ্ছে না। আপিল বিভাগের নির্দেশনার পর এসব বিষয়ের নিষ্পত্তি হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করতে পারি। এজন্য নির্দেশনাপ্রাপ্ত দুই পক্ষ- আইনশৃংখলা বাহিনী এবং ম্যাজিস্ট্রেট-বিচারক-ট্রাইব্যুনাল নির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। অনেক হয়েছে, আর নয়। ১৯৯৮ সালে ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুবেল ডিবি কার্যালয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করার পর থেকেই ৫৪ ও ১৬৭ ধারা প্রবলভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। ২০০৩ সালে হাইকোর্ট এক রায়ে এই দুই ধারার কিছু বিষয় সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও মত দিয়েছিলেন। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে করা রাষ্ট্রপক্ষের রিট সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক খারিজ হওয়ার অনেকদিন পার হওয়ার পর এবার আমরা আপিল বিভাগের নির্দেশনা পেলাম। এই নির্দেশনা যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতে হবে, সম্মান দেখাতে হবে আদালতের রায়ের প্রতি। বিষয়টি সমগ্র দেশবাসীর মানবাধিকারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.