মিমি আমার হাতটা ওর মুঠোর মধ্যে ধরে রাখে …
আমার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা গড়াচ্ছে, কিছুতেই থামাতে পারছিনা আমি। ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটের সাদা বিছানার চাঁদর চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছে করছে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যাবার। আমি সহ্য করতে পারছি না কিছুতেই। একেবারেই সহ্য করতে পারছিনা এই পরিস্থিতি। মিমি তাই আমার হাত ধরে আছে।
– আমাকে ছেড়ে যেওনা তুমি, প্লিজ। আমার ভয় করে।
আমার খুব ইচ্ছে করছে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদি। ছেলে মানুষের কান্নাটা ফুরিয়ে যায় সেই ছোটবেলাতেই। এর পর ছেলেরা আর কাঁদে না, কাঁদতে পারেনা, অথবা কাঁদতে হয় না। পুরুষ মানুষ হবে পাথরের মত। শত আঘাতেও থাকবে স্থির। আমিও তো এমনই ছিলাম। আবেগ জিনিসটাকে প্রশ্রয় দেইনি কখনও। কিন্তু আজ আমার ভেতরের পাথর চাঁপা আবেগ গলে গিয়ে অগ্নিগিরির লাভার স্রোতের মত আমার চোখের কোণ পুড়িয়ে দিয়ে নেমে আসছে বিছানায়।
– দেখো, তুমি এমন করে ভেঙ্গে পড়লে চলবে? বাবুটাকে দেখবে কে বলো? আমাদের একটাই বাবু, ছোট্ট, এত্তটুকু।
গলা ধরে আসে মিমির।
আমি আর পারি না, ঝটকা দিয়ে মিমির হাত ছাড়িয়ে নেই। দরজা পর্যন্ত গিয়ে থমকে দাঁড়াই। না, বাবুকে এখানে আনা যাবে না। আমাদের বাবুটা এই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেড়ে উঠুক, এটা চাইনা আমি। ছুটে এসে মিমির হাত ধরি। ও কিভাবে যেন বুঝে যায় –
– বাবুকে এনো না কাছে। বাবু আমাকে এভাবে দেখুক আমি চাই না।
গলার স্বর নিস্তেজ হয়ে আসছে মিমির। প্রতি মুহূর্তে ও একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে।
– এই শোনো, তোমার সোনা বউটার না খুব ভয় করছে। তুমি তাকে একটা গল্প শোনাও না, প্লিজ … ওই যে, বিয়ের রাতে আমাকে যে গল্পটা শুনিয়েছিলে, সেই পাতার গল্পটা …
কি চমৎকার একটা দিন ছিল সেদিন। ভালবাসাবাসির শুরুতেই আমরা বুঝে গেছিলাম, একে ছাড়া আমার চলবে না কিছুতেই। তাই বিয়ের জন্য ভাবতে হয়নি একেবারেই। আমার দুই বন্ধু আর ওর দুই বান্ধবী ছিল বিয়ের সাক্ষী। কোর্টের ঝামেলা মিটিয়ে আমরা চলে গেছিলাম চাইনিজ হোটেলে। নিজেকে খুব সুখী আর পূর্ণ মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। এক নিমিষে ছেলেমানুষি গুলো হাওয়া হয়ে গেছিলো। বিয়ের পর যখন আমি ওর হাত ধরলাম সেদিন, আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এই মানুষটাকে আমি কোন দিন কোন কষ্ট পেতে দেবো না। যতই দুঃখ আসুক, আমি নিজে ঢাল হয়ে সামনে দাঁড়াবো।
সেদিন রাতে, আমাদের বাসর হয়েছিল নবীনদের ছোট্ট বাসাটায়। অনেক রাত পর্যন্ত ওরা যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে পাগল বানিয়ে ছেড়েছিল আমাদের। এরপর না না রকম দুষ্টু ইঙ্গিতপুর্ণ কথা বলে ঘর ছেড়েছিল সবাই। আমি দরজা বন্ধ করে বিছানার কাছে আসতেই মিমি বলেছিল – “একটু দাঁড়াও”। আমি বুঝিনি ও কি করতে চায়। মিমি বিছানা থেকে উঠে এসে মাথায় ঘোমটা টেনে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো আমাকে। আমি তাড়াতাড়ি ওকে দুহাতে ধরে তুলে চুমু খেলাম ওর কপালে। এরপর অনেকক্ষণ ও মিশে রইলো আমার বুকের সাথে। এক সময় আমার বুকের ভেতর থেকেই বলে উঠলো – “চলো বারান্দায় গিয়ে বসি”। আমি সায় দিলাম, কিন্তু ও নড়লো না। বললাম – “চলো যাই”। “আমার যে এখান থেকে নড়তে ইচ্ছে করছে না, হাঁটতেও ইচ্ছে করছে না, কিন্তু বারান্দায় যেতে ইচ্ছে করছে”। আমি বললাম – “তাহলে আমার পায়ের উপর উঠে এসো”। ও একটু অবাক হয়ে আমার পায়ের উপর ওর পা রাখলো। আমি ওকে জড়িয়ে ধরেই আস্তে আস্তে হেঁটে বারান্দা পর্যন্ত এলাম। সেদিন বারান্দায়, আমার কোলে মাথা দিয়ে মিমি একই ভাবে বলেছিল একটা গল্প শোনাতে।
– “এক দেশে ছিল এক দস্যি পাতা। দমকা হাওয়ায় উড়তে উড়তে সেই পাতাটা একদিন গিয়ে পড়লো বিশাল এক দিঘীর মাঝখানে। পানিতে পড়ে দস্যি পাতাটা আর উড়তে না পেরে ছটফট করতে লাগলো মুক্তি পাবার জন্য। অনেক চেষ্টার পর পাতাটা এক সময় দিঘীর পাড়ে এসে পৌছাতে পারলো। মুক্তির আনন্দে নেচে উঠতে যাবে পাতাটা, সেই সময় সে দেখতে পেল দিঘীর পাড়ে একাকী বসে একটি মেয়ে। মেয়েটার রূপ আগুন ঝরায় না, বরং তার স্নিগ্ধতা ছড়ীয়ে পড়ে পুকুরের পানিতে, পানি থেকে আকাশে। পাতাটা অবাক হয়ে দেখে, কি আশ্চর্য রকম নীরব হয়ে গেল প্রকৃতি তখন। থেমে গেল দমকা হাওয়া, দিঘীর কালো জল শান্ত হয়ে এলো। পাতাটা ভাসতে ভাসতে মেয়েটার খুব কাছে চলে এলো। মেয়েটা কেন যেন পাতাটাকে দেখে খুশী হয়ে উঠলো, বললো – “ও মা, কি সুন্দর একটা পাতা। এই পাতা, তুমি কোত্থেকে এলে এখানে?”। পাতা কিছুই বলতে পারলো না, শুধু অপলক চেয়ে রইলো মেয়েটির দিকে। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো – এই দিঘি ছেড়ে সে কোথাও যাবে না, কোন দিনও না।”
সেদিনের মতই আজও মিমির গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে মুক্তো কণা। আজও মিমি শক্ত করে ধরে আছে আমার হাতটা ওর হাতের মুঠোয়।
সেদিন আমার চোখে অশ্রু ছিলনা … আজ আমার চোখেও অশ্রু। মিমি হারিয়ে যাচ্ছে আমার জীবন থেকে। আমি কোন ভাবেই ধরে রাখতে পারছি না ওকে আমার জীবনে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়েছেন, বলে দিয়েছেন মিমি আর কয়েক ঘণ্টা মাত্র থাকবে আমাদের সাথে। প্রার্থনা ছাড়া আর কিছুই করবার নেই এখন।
আমি মিমির হাতটা জড়িয়ে ধরে বিছানার পাশে বসে আছি … চারিদিক কেমন শূন্য লাগছে আমার …
আমার সোনা বউটা একটু একটু করে দূরে চলে যাচ্ছে আমাদের সবার কাছ থেকে … দূরে চলে যাচ্ছে … দূরে চলে যাচ্ছে
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.