ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে রাজধানীর ফুটপাথ দখলে রাখা হকাররা। এতে কিছুতেই মুক্ত করা যাচ্ছে না রাজধানীর বেশির ভাগ ফুটপাথ। হকারদের দাপটের কাছে দৃশ্যত অসহায় হয়ে পড়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। হকারদের পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন থাকায় এমনটি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। ফলে মেয়রের নির্দেশ উপেক্ষা করে ফুটপাথের পাশাপাশি রাস্তাও দখল করে রেখেছে হকাররা। এতে ব্যাহত হচ্ছে নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। অনেক সময় প্রতিবাদ করতে গেলে হকারদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন পথচারীরা। সম্প্রতি গুলিস্তানে হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে একাধিক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। কিন্তু হকার উচ্ছেদ হচ্ছে না কিছুতেই। সরজমিন দেখা গেছে রাজধানীর বেশির ভাগ ফুটপাথ দীর্ঘদিন থেকে হকাররা দখল করে ব্যবসা করে আসছে। অনেকস্থানে স্থায়ী মার্কেট বানিয়ে ফেলেছে তারা। বিশেষ করে গুলিস্তান, নিউ মার্কেট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট এলাকা, বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকা, ফকিরাপুল, নয়া পল্টন, পুরানা পল্টন, দৈনিক বাংলার মোড়, মালিবাগ, মতিঝিল, শাহবাগ, শহীদ জিয়া শিশু পার্ক, যাত্রাবাড়ী এলাকা এর মধ্যে অন্যতম। এসব স্থানে ফুটপাথের পাশাপাশি রাস্তাও দখল করে রেখেছে হকাররা। ফুটপাতের দোকান থেকে অল্প দামে জিনিসপত্র কিনতে পারলেও চলাচলে ব্যাপক দুর্ভোগে পড়েন পথচারীরা। এ কারণে ব্যাপক ক্ষুব্ধ নগরবাসী। বিভিন্ন সময় তারা ফুটপাথ থেকে অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদের দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের দাবির কারণে সিটি করপোরেশন থেকে বারবার হকার উচ্ছেদে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালেও প্রতিবারই সকালে উচ্ছেদ করলে বিকালে দোকানপাট নিয়ে বসে যায় হকাররা। অনেক সময় সকাল-বিকাল দুবার উচ্ছেদ অভিযান চালালেও আবার পরক্ষণে দোকান নিয়ে বসে পড়ে তারা। সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা জানান- গুলিস্তান, নিউ মার্কেট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় গত কয়েক মাসে কমপক্ষে ১০ বার করে অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু এখন আবার সেই আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, হকাররা বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নেতাদের কর্মী হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকেন। নেতারা নিজেদের অবস্থান জানান দিতে মিছিলে হকারদের নিয়ে যান। এ ছাড়া সরকারি রাস্তা ও ফুটপাতে ব্যবসা করলেও এসব হকারের কাছ থেকে সরকারি দলের নেতারা চাঁদাবাজি করেন। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা লাইনম্যানদের মাধ্যমে চলে যায় তাদের কাছে। মাস শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় কয়েক কোটি টাকা। এ টাকার অংশ সিটি করপোরেশন, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীসহ বিভিন্ন দপ্তরেও যায় বলে প্রচার আছে। ফলে মেয়রসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টার পরও হকার মুক্ত হচ্ছে না ফুটপাথ-রাস্তাঘাট। ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বিষয়টি নিয়ে বারবার ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সম্প্রতি সিটি মেয়র হকারদে ফুটপাথ ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে রাস্তা ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু কিছুদিন তার সে নির্দেশ মানলেও এখন আর মানছে না হকাররা। বরং মেয়রের নির্দেশ উপেক্ষা করে ফুটপাথের পাশাপাশি রাস্তাও দখল করে নিয়েছে তারা। গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, নিউ মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে। এদিকে, গুলিস্তান এলাকায় থাকা ২৫০২ জন হকারের তালিকা তৈরি করেছে সিটি করপোরেশন। তাদের পরিচয়পত্র দিয়ে পুনর্বাসন অথবা হলিডে মার্কেটে স্থানান্তরিত করা ছিল সিটি করপোরেশনের লক্ষ্য। এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকেও গত আগস্ট মাসে ডিএসসিসিকে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। এতে হকারদের উচ্ছেদ না করে বিকল্প হিসেবে হলিডে মার্কেটের ব্যবস্থা করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এজন্য ২২টি স্থানও নির্দিষ্ট করেছে। তবে এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপই এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এ পর্যায়ে সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে গিয়ে বড় আকারের বাধার মুখে পড়ে। গুলিস্তানের ফুটপাথের হকারদের তরফে এই বাধা আসে। ওই দিনের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, সিটি করপোরেশন হকারদের পুনর্বাসনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ফুটপাথ দখলমুক্ত হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের নিয়মিত উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাই। কিন্তু গুলিস্তানে উচ্ছেদ অভিযানকে কেন্দ্র করে নগর ভবনে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেখানে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট গেছেন, সরকারি কর্মকর্তারা লাঞ্ছিত হয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা নগর ভবনে ফিরে যান। তবু কিছু হকার নামধারী লোক নগর ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর চড়াও হয়। এটা অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত, দুঃসাহসিক কাজ। কোনোভাবেই তা মেনে নেয়া যায় না। এ ধরনের ঘটনা যদি ভবিষ্যতে হয়, তবে কঠোরতর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মেয়র বলেন, ‘এ শহরের ৬০-৬৫ শতাংশ লোক পায়ে হেঁটে গন্তব্যস্থলে যান। তাদের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে আমাদের প্রয়াস চলছে। এ শহরের মানুষের জীবনকে স্তব্ধ করে দেয়ার অধিকার কারও নেই। সাঈদ খোকন বলেন, ‘কিছুদিন আগে সায়েদাবাদ এলাকায় কয়েক যুগ থেকে চলা অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করেছি। কর্মসংস্থানের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে দ্রুততম সময়ে অন্ততপক্ষে ঢাকার গুলিস্তান এলাকাকে অবৈধ দখলমুক্ত করব। এ ব্যাপারে আমি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহযোগিতা কামনা করছি। গুলিস্তানের উচ্ছেদ অভিযানে গুলি চালানো বিষয়ে মেয়র বলেন, গুলিস্তানে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু লোক ভাবাবেগতাড়িত হয়ে, উচ্ছ্বাসের বশবর্তী হয়ে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এটা আমরা সমর্থন করি না। আমরা যেন কোনো পরিস্থিতিতে আইন নিজের হাতে তুলে না নিই। এটা একটা মহতী উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ বিষয়ে পুলিশকে বলা আছে, তারা নিজস্ব গতিতে তদন্তকাজ চালাবে। মেয়র বলেন, হকারদের সাময়িকভাবে পুনর্বাসনের জন্য ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চের বাইরের খালি জায়গা ব্যবহার করা হবে। প্রসঙ্গ, সায়েদাবাদ ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদে বাধা দেয়ার কারণে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান হাবু সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। গুলিস্তান ফুটপাথ দখল মুক্ত অভিযানে বাধা, হট্টগোল কর্মকর্তা কর্মচারীদের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা হয়েছে। সেদিন অস্ত্র প্রদর্শনের অভিযোগে দুই ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে দুই ছাত্রলীগ নেতা পলাতক রয়েছেন। তবে শেষ খবর হলো, এত কিছুর পরও রাজধানীর সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানের ফুটপাথ পথঘাট হকার মুক্ত হয়নি। জনদুর্ভোগের অবসানও হয়নি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.