প্রবাসে এক মাসে যত থালা বাসন মাজি, বাংলাদেশের কোনো ধরাবাঁধা কাজের বুয়ার থেকে তা কোনো অংশে কম নয়। এখনো অনুভব করি, মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যবিত্ত রাজপুত্র আমি। দেশে থাকতে বাসন মাজা তো দূরের কথা, নিজের প্লেটটাও কখনো পরিষ্কার করে কিছু খাইনি বা খাওয়ার পরে পরিষ্কার করার প্রয়োজন বোধ করিনি। বাসায় কাজের বুয়ার কাছে জমা দিয়ে আসতাম আর মনে মনে বলতাম, নে ধর বেটি, পরিষ্কার কর৷ আমাদের বাসায় কোনো মাইক্রোওভেন ছিল না যে তাতে চটপট গরম করে খাব। সত্যি বলতে ছোটবেলায় মাইক্রোওভেন কী জিনিস সেটাই চিনতাম না৷ মাঝে মাঝে আমার মা শারীরিক অলসতা বা অসুস্থতার জন্য ফ্রিজের ঠান্ডা ভাত, তরকারি অফার করে বলতেন, নে বাবা দয়া করে খা। কী, এই ঠান্ডা ভাত খাব? সেটা নিয়ে মার সঙ্গে আমার কী অসীম রাগ, অভিমান আর জেদ৷ বড় সংসারের সব থেকে কনিষ্ঠ সদস্যপদ আমার। এমন মধ্যবিত্ত সংসারের সকল কনিষ্ঠ ছেলেমেয়েই বুঝতে পারবে বাবা-মা এবং বড় ভাইবোনদের কাছে তার দাবি কতখানি৷ জেদ করে না খেয়ে থেকে মাকে মানসিক কষ্ট দিয়ে আনন্দ নেওয়া ছিল একটা সাধারণ ঘটনা৷ নিজের বাড়ন্ত শরীরকে অভুক্ত রাখার জন্য যতটা না খারাপ লাগত তার থেকে বেশি মজা পেতাম, আমার না খেয়ে থাকার জন্য মায়ের ছটফটানি দেখে৷ পৃথিবীতে নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মনে হতো৷ এত বড় সাহস, আমি ঠান্ডা ভাত খাব, ঠান্ডা তরকারি খাব? গরম করার কেউ নেই। এত বড় ঘটনা৷
মাঝে মাঝে জেদ করে ঘরের ছিটকিনি আটকে নিজেকে বন্দী করে রাখতাম আর অপেক্ষায় থাকতাম, মা আমার কখন নক করেন৷ মা নক করতে বেশি দেরি করে ফেললে ক্রোধ আরও বেড়ে যেত। মেঝেতে শুয়ে হাত পা ছোড়া আর চিৎকার করে কাঁদতাম। যে ফরম্যাটটাকে বর্তমানে নাগিন ড্যান্স নামকরণ করা হয়েছে৷ তবে বাস্তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হতো না, আমার মা খুব সহজ সরল একজন মা৷ তিনি যখন নক করা শুরু করতেন, অনুভব করতাম মা অস্থির হয়ে গেছেন আমাকে বন্দীদশা থেকে উদ্ধারের জন্য। তাঁর ভাবনা, না জানি আমি বাঁদরটা বন্দী ঘরে কী করছি৷ নিজেকে অনেকটা মূল্যবান রত্ন পাথর মনে করে গর্বিত হতাম। যদিও আমার নামটাও মূল্যবান রত্নের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছিল৷ মনে মনে ভাবতাম, যাক মাকে টেনশন দেওয়া গেছে। কী যে মজা মাকে অশান্তিতে রেখে৷ অভুক্ত থেকে যতটা না দুর্বল হতাম, তার থেকে বেশি থাকত দুর্বলতার অভিনয়। না খেতে পেরে খুব কষ্ট হচ্ছে, জীবন যায় যায়, ঠিক এমন ধাঁচের অভিনয়৷ বাস্তবতা হচ্ছে, একটা বয়সে এই অভিনয়টা সব ছেলেমেয়েই তাদের মায়ের সঙ্গে করতে পারে। পৃথিবীতে মায়েরা কেন যে এত বোকা হয়, জিনিসটা মাথায় আসে না৷ সৃষ্টিকর্তার এক অপূর্ব রহস্যময় সৃষ্টি এই মা৷ হায়রে জীবন কোথায় থেকে কোথায় এনে ফেলে৷ মধ্যবিত্ত বাবা-মায়ের রাজ্যের রাজপুত্র এখন রাজবুয়া৷ গাদা গুচ্ছের অখাদ্য কুখাদ্য রান্না করে যখন জোরপূর্বক গিলতে থাকি আর স্বাদ নিতে থাকি, আহ, কী মজা৷ কেউ আর আদর করে ডাকতে আসেন না, খাবি না, খেয়ে নে, খাচ্ছিস না কেন? ভাত ঠান্ডা হয়ে গেল৷ আমার মা আজ সাড়ে পাঁচ হাজার মাইল দুরে। আমি যে এখনো অভুক্ত কারও মধ্যে সেই অস্থিরতাটা নেই৷ প্রকৃতিগত অস্থিরতা, সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত অস্থিরতা, আর ওই এঁটো বাসনগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকি, ওই কাজের বুয়াকে যদি পার আওয়ার পঞ্চাশ সেন্ট চুক্তিতে পারমানেন্ট চাকরি দিয়ে ফেত্রাকে (কন্ট্রাক্ট) সাইন করিয়ে বাসনগুলো যদি মাজিয়ে নিতে পারতাম!
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.