সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনের এখনও প্রায় দু’বছর বাকি। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর তোড়জোড় ভিন্ন বার্তা দিতে চাইছে। গত কয়েক মাস থেকে সবার মুখে নির্বাচনী প্রচারণার কথা। ভোট চাইতে নেতাকর্মীদের বলা হচ্ছে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যেতে। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি প্রায় দু’মাস আগে সিলেট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে। বিএনপি তো নির্বাচনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। তারা স্বাধীন ও শক্তিশালী নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন ছাড়াও ইতিমধ্যে বিশদ প্রস্তাবনা দিয়েছে। আর সবকিছু ছাপিয়ে এখন বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে অর্থমন্ত্রীর একটি বক্তব্য। রোববার তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ‘প্রধানমন্ত্রীর সিলেট সফর দিয়েই আগামী নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করবে আওয়ামী লীগ।’
এ বক্তব্য শুনে সবাই নড়েচড়ে বসছেন। এটি আগাম নির্বাচনের ইঙ্গিত কিনা তা বিশ্লেষণ করে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অবশ্য এ নিয়ে তাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। কেউ বলছেন, কারণ যাই হোক দেশে জাতীয় নির্বাচনের একটা আবহ তৈরি হয়েছে। সরকার পরিচালনা অব্যাহত থাকলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য মোটেও সুখকর নয়, তাই জনমতকে কাছে টানতে একটু আগেভাগে তারা মাঠে নেমেছে। সময় এবং সুযোগ পক্ষে থাকলে নাটকীয়ভাবে আওয়ামী লীগ আগাম নির্বাচনের চমকও দিতে পারে। তবে সে ঘোষণার জন্য আগামী বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত তো অপেক্ষা করতেই হবে। এর আগে কিছুই হবে না। কেউ বলছেন, প্রস্তুতির ধরন আগাম নির্বাচনের পদধ্বনি। তবে এ কথা সত্য যে, সাধারণ মানুষ সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে অধীর আগ্রহে বসে আছে। কিন্তু যারা এ অংককে সরল সমীকরণে মেলাতে চান না তাদের কাছে এই নির্বাচনী ডামাডোল প্রধান দলগুলোর নিজস্ব কৌশলগত দিক ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের মতে, সরকার নির্বাচনের জন্য আগাম প্রস্তুতি নেয়ায় বিএনপিও প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে। সবাই মোদ্দাকথা হিসেবে বলছেন, এত আগে আগাম নির্বাচনী প্রস্তুতি প্রচারণার অন্তরালে রয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির জনমত তৈরির রাজনৈতিক কৌশল। কে কার পক্ষে কত ভোট টানতে পারবে এখন থেকেই তার হিসাব-নিকাশ চলছে। কেননা, আগামী নির্বাচন আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো করা সম্ভব হবে না। সব দলের অংশগ্রহণে আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচন একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিতে পারে।
প্রসঙ্গত, বুধবার প্রধানমন্ত্রী সিলেট সফরে যাচ্ছেন। এ সময় হজরত শাহ জালাল (রহ.) এবং শাহ পরান (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করবেন তিনি। এ ছাড়া সিলেটের নেতাদের নিয়ে বসবেন এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেবেন। এদিন দুপুর ২টায় সিলেটের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জনসভায় ভাষণ দেয়া এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করার কথাও ছিল প্রধানমন্ত্রীর। এ জন্য নেয়া হয়েছিল যাবতীয় প্রস্তুতি। কিন্তু রোববার জেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হওয়ায় শেষ মুহূর্তে জনসভার কর্মসূচিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনের অনুষ্ঠান স্থগিত রাখা হয়েছে। তবে জনসভায় ভাষণ না দিলেও নানা কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সিলেট সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করছেন শাসকদলের দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী।
এ সফরসূচি নির্ধারণ হওয়ার পর গত ৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সিলেটে দলের এক কর্মিসভায় বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নতুন বার্তা নিয়ে আসছেন।’ নতুন কী বার্তা নিয়ে আসবেন প্রধানমন্ত্রী? রোববার সিলেটে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সিলেট সফর দিয়েই আগামী নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করবে আওয়ামী লীগ।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘প্রশ্নটা আমারও, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এত আগে কেন নির্বাচনী প্রচারণায় নামছেন। যেখানে এখনও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের কাজ শুরুই হয়নি। আগামী ফ্রেব্র“য়ারির মধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। এখনও সে নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সেখানে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) সিলেটে মাজার জিয়ারতের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করছেন, আমার কাছেও এ বিষয়টি স্পষ্ট না।’ তিনি আরও বলেন, যদি এ বিষয়টি মাথায় রেখে বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে চান তাহলে তা হবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। আর যদি তা না করে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকবেন, তার মন্ত্রিপরিষদ বহাল থাকবে, ২০১৭ সালের প্রথম দিকে নিজের সুবিধা অনুযায়ী তার অধীনে ৫ জানুয়ারির মতো আরও একটি নির্বাচন করবেন, তাহলে তিনি ভুল করবেন।’
অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তাসহ সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে- তিনি একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছেন। যিনি একবার বলছেন- সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আবার তিনি দলের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন সময় জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিচ্ছেন। তার দলের শীর্ষ নেতারাও একই সুরে কথা বলছেন। আসলে প্রধানমন্ত্রী কী করতে চাচ্ছেন, তা কারও কাছেই স্পষ্ট নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমিও অনেকের কাছে জানতে চাই- আসলে প্রধানমন্ত্রী কি চান?’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার মতে, দেশে আগাম নির্বাচনের একটি আবহ তৈরি হয়েছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, দেশে আগাম নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা রয়েছে। আমার বিশ্বাস, নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়েই অনুষ্ঠিত হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অতীতে বড় দলগুলো ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে। এবার তারা বেশ আগেভাগেই অনেকটা ঘোষণা নিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। হয়তো জনমত নিজেদের পক্ষে নেয়ার জন্য দেশে একটি নির্বাচনী আবহ সৃষ্টির জন্যই এ উদ্যোগ নিয়েছে বড় দলগুলো।’
প্রায় দু’বছর হাতে থাকা সত্ত্বেও এখনই নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করাটাকে আগাম নির্বাচনের পূর্বাভাস বলতে নারাজ বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ। সোমবার যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘একেকজন একেকভাবে বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করছেন। আমি মনে করি না, ২০১৮ সালের আগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ মাহফুজ উল্লাহ বলেন, ‘শাসক দল আওয়ামী লীগের মধ্যে নানা সমস্যা বিদ্যমান। তারা এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে এবং দলকে গুছিয়ে নিতে নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা বলছে। এটা তাদের রাজনৈতিক কৌশল। অন্যদিকে যদি আকস্মিকভাবে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়, এমন ভাবনা মাথায় রেখে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি। এটাও তাদের রাজনৈতিক কৌশল।’ তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো একটি বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। এই সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হলে তারা উন্নয়নের একটি বড় চমক দেশবাসীর সামনে তুলে ধরবে। তাছাড়া ২০২০ সাল এবং ২০২১ সাল আওয়ামী লীগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২০ সাল শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবাষির্কী এবং ২০২১ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। আওয়ামী লীগ চাইবে এ সময় ক্ষমতায় থাকতে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতি দেখে মনে হচ্ছে তারা জাতীয় নির্বাচনের দিকেই এগোচ্ছে।’ সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় নির্বাচন দেখার জন্য মানুষ উগ্রীব হয়ে আছে।’ তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে তার দলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। তার এ নির্দেশনা অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। এখনই নেতাকর্মীদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলা আগাম নির্বাচনের সংকেত কিনা তা সময়ই বলে দেবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘গণতন্ত্রের অন্যতম উপাদান হল নির্বাচন। দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ সুসংহত করতে অবশ্যই নির্বাচন হতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার উদ্যোগ নেবে বলে আমরা আশা করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপি আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। নির্বাচনের লক্ষ্যেই আমাদের চেয়ারপারসন ইসি পুনর্গঠনের রূপরেখা দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে দলের সাংগঠনিক কাজও দ্রুত শেষ করা হচ্ছে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি উৎসবমুখর পরিবেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে দেশবাসী এমনটাই প্রত্যাশা করছেন।’ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য দুই-আড়াই বছর খুব বেশি সময় নয়। এখন থেকে জনসংযোগ শুরু করলেও অনেক কাজ বাকি থেকে যাবে। তাই কেন্দ্র থেকে নির্বাচনী প্রস্তুতির ওপর জোর দেয়া হয়েছে।’
জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার এমপি যুগান্তরকে বলেন, ‘সিলেট থেকে আমরা আমাদের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছি। শিগগির রংপুর এবং বরিশাল বিভাগে দুটি জনসভার আয়োজন করব। এরপর পর্যায়ক্রমে দেশের সব কটি বিভাগ এবং জেলায় আমরা সমাবেশ করব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ধরেই নিয়েছি, যে কোনো সময় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। তাই আমাদের এখন একটাই লক্ষ্য- এ নির্বাচনে ভালো ফলের জন্য নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া। আমরা সে লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যাচ্ছি।’ এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘আমাদের দেখাদেখি এখন আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ অন্যরাও জোরেশোরে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে। নির্বাচন যেদিনই হোক, জাতীয় পার্টি এ নির্বাচনে অংশ নেবে।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.