ডনাল্ড ট্রাম্প ও ইভাংকা ট্রাম্পের সঙ্গে জারেড কুশনার
নব নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণ দলে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি হলেন একজন ৩৫ বছর বয়সী ধনাঢ্য আবাসন ব্যবসায়ী ও প্রকাশক। তার নাম জ্যারেড কুশনার। তিনি ট্রাম্পের প্রভাবশালী কন্যা ইভাংকা ট্রাম্পের স্বামী। মতান্তরে তিনিই হয়ে যাচ্ছেন হোয়াইট হাউসে পা রাখা সবচেয়ে প্রভাবশালী জামাতা! বৃটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ান এক নিবন্ধে তাকে এভাবেই বর্ণনা করেছে। ট্রাম্প শিবিরের প্রচারাভিযানের শেষ পর্যায়ে কুশনারই কার্যত ক্যাম্পেইন ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন। নির্বাচনী কৌশল প্রণয়নে ট্রাম্পকে পরামর্শ দেওয়া, তার বক্তৃতার খসড়া তৈরি করা ও ডিজিটাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন পরিচালনা করার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন এই তরুণ। ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত বিজয়ের ৮ দিন পর, কুশনার এবার আবির্ভূত হয়েছেন এক ভিন্ন রূপে। ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের প্রক্রিয়া তথা নতুন প্রশাসনে নিয়োগের প্রক্রিয়া বেশ অগোছালো হয়ে গেছে। বিশৃঙ্খল এ প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে রয়েছেন কুশনার। ভেতরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলছেন যেভাবে একে ওকে সরানো হচ্ছে, তা স্তালিনের আমলের কথাই মনে করিয়ে দেয়। কেউ আবার একে ‘চাকু যুদ্ধ’ আখ্যায়িত করেছেন। গত শুক্রবার আকস্মিকভাবে নিউ জার্সির সাবেক গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টিকে ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণ প্রক্রিয়ার প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার স্থলে এই কাজের ভার দেওয়া হয় নব নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে। শুধু তা-ই নয়, ক্রিস্টির বাছাই করা সবাইকেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি তাকে অ্যাটর্নি জেনারেল বানানো হতে পারে শোনা গেলেও, ক্রিস্টির সেই আশায় গুড়েবালি। কারণ, ইতিমধ্যে সিনেটর জেফ সেশন্সকে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখন আদৌ ট্রাম্প প্রশাসনে ক্রিস্টি কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ পাবেন কিনা, তা নিয়েই রয়েছে সংশয়। ধারণা করা হয়, ক্রিস্টিকে সরিয়ে দেওয়ার পেছনে কাজ করেছে কুশনারের সঙ্গে তার বিবাদ। নিউ জার্সির ফেডারেল কৌঁসুলি হিসেবে জ্যারেডের পিতা চার্লস কুশনারের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছিলেন ক্রিস্টি। পরে আয়কর ফাঁকি, সাক্ষী গরমিল ও অবৈধ নির্বাচনী অনুদান প্রদানের অভিযোগে চার্লসের বিচার হয়। এ সময় নিউ জার্সির প্রধান আইন কর্মকর্তা, অর্থাৎ অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন ক্রিস ক্রিস্টি। দুই বছরের কারাদণ্ড পান চার্লস, এক বছর খেটে বেরিয়ে যান। চার্লস জেলে থাকার সময়, জ্যারেড তার পিতার আবাসন ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সপ্তাহের শুরুতে ট্রাম্প টিম থেকে আরও দুই জন জ্যেষ্ঠ সদস্যকে অপসারণ করা হয়। একজন হলেন মাইক রজার্স, যিনি ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুগুলোর দেখভাল করছিলেন। আরেকজন ম্যাথিউ ফ্রিডম্যান। তিনি একজন লবিস্ট এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি সরকারের লিয়াজোঁ রক্ষা করতেন। এদের দু’জনেই ক্রিস ক্রিস্টির মিত্র ছিলেন। এর আগে প্রচারাভিযানের মধ্যে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দেশটি সফরের আমন্ত্রণ জানান। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল লিখেছে, মেক্সিকানদের নিয়ে মানহানিকর কথাবার্তা বলেছেন ট্রাম্প। সে-ই ট্রাম্প মেক্সিকো সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন, এটা অনেকে ভাবতে পারেননি। কিন্তু নাটকীয় এ সিদ্ধান্তটি নিতে ট্রাম্পকে উৎসাহিত করেছেন তার জামাতা। সুদর্শন ও লম্বা গড়নের জ্যারেড কুশনার পড়ালেখা করেছেন হাভার্ড ও নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে ‘দ্য প্রাইস অব অ্যাডমিশন্স: হাউ আমেরিকা’স রুলিং ক্লাস বাইজ ইটস ওয়ে ইনটু এলিট কলেজেস’ বইয়ের লেখক ড্যানিয়েল গোল্ডেন বলেছেন, চার্লস কুশনার হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ লাখ ডলারের অনুদান দিয়েছেন। এ কারণেই প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তার পুত্র জ্যারেড। মাত্র ২৬ বছর বয়সে, বড় বড় চুক্তি স্বাক্ষরে অভ্যস্ত হয়ে যান তিনি। ২০০৭ সালে, ফিফথ অ্যাভিনিউতে একটি অফিস কেনেন রেকর্ড ১৮০ কোটি ডলারে! তবে এ অর্থের বেশিরভাগই ধার করা। তবে ট্রাম্পের আশেপাশে থাকা কট্টর ডানপন্থি সহযোগীদের তুলনায় তার একটি বৈশিষ্ট্য একেবারে আলাদা। কারণ, জ্যারেড একজন ইহুদি। একটি রক্ষণশীল ইহুদি পরিবারে তার জন্ম। ২০০৯ সালে ইভাংকা তাকে বিয়ে করার জন্য ইহুদি ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। ২০০৫ সালে তাদের প্রেম হয় বটে। কিন্তু ছেলের বৌ হিসেবে জ্যারেডের পিতামাতার পছন্দ ছিল একজন ইহুদি মেয়ে। নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিন জানায়, ধর্মীয় পার্থক্যের কারণে তাদের মধ্যে একবার ছাড়াছাড়ি হয়ও। তবে মিডিয়া মুঘল রুপার্ট মারডকের স্ত্রী তাদের আবার এক করেন। পরের বছরই তারা বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইহুদি বিদ্বেষের বিস্তর অভিযোগ ছিল। কিন্তু জারেড এ ক্ষেত্রে শ্বশুরের পক্ষালম্বন করেছেন বারবার। নিজের মালিকানাধীন নিউ ইয়র্ক অবজারভারে তিনি এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখতেও কসুর করেননি। ইসরাইলি বাম ঘরানার পত্রিকা হারেৎস জানিয়েছে, নির্বাচনী প্রচারাভিযানের মাঝামাঝি ট্রাম্প ও তার ঘনিষ্ঠ কিছু লোকের বক্তব্য প্রভাবশালী ইহুদিদের অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। বিশেষ করে, তার ইহুদিদের নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা, আর ইসরাইল সংকটে মধ্যপন্থা অবলম্বনের বিষয়টি অনেক ইহুদি ভালোভাবে নেননি। তাদের আয়ত্তে আনতে আমেরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ইহুদি সংগঠন আইপ্যাকের একটি সম্মেলনকে ব্যবহার করেন ট্রাম্প। ওই সম্মেলনে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক দলের শীর্ষ দুই প্রার্থী অংশ নেন। এ সময় ট্রাম্প ইসরাইলের পক্ষে কট্টর অবস্থান নিয়ে একটি বক্তব্য দেন। এ বক্তব্যে তিনি জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের প্রতিশ্রুতি দেন। এ ঘোষণা দীর্ঘদিনের মার্কিন নীতির বিরোধী। কিন্তু এ চমকপ্রদ প্রতিশ্রুতির দরুন অস্বস্তিতে থাকা অনেক ইহুদি তাকে সমর্থন ও অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। হারেৎসের খবরে বলা হয়, এই নাটকীয় ও বিতর্কিত প্রতিশ্রুতি এবং আইপ্যাকে দেওয়া বক্তব্য তৈরিতে শ্বশুরকে সাহায্য করেছেন কুশনার ও আমেরিকায় নিযুক্ত ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত রন ডার্মার। ট্রাম্পও নিজের জামাতাকে ‘গ্রেট গাই’ বলে বর্ণনা করেছেন। কিছু খবরে বলা হচ্ছে, নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নজিরবিহীনভাবে মেয়ের জামাইয়ের জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ছাড়পত্র দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। এতে করে সর্বোচ্চ গোপনীয় প্রেসিডেন্সিয়াল ব্রিফিংয়ের সময় জ্যারেডও উপস্থিত থাকতে পারবেন। মঙ্গলবার প্রথম ব্রিফিং হয়েছে। তবে এটি জানা যায়নি যে, ট্রাম্পের এ অনুরোধ রাখা হবে কিনা। মার্কিন প্রেসিডেন্টরা সাধারণত স্বজনদের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে রাখেন না। তাই ট্রাম্পের এমন পদক্ষেপ স্বজনপ্রীতির জোরালো অভিযোগ তুলেছে। তবে হোয়াইট হাউসে জ্যারেড কুশনারের বড় পদ পাওয়ার সম্ভাবনা সীমিত। কারণ, তার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের আত্মীয়তা রয়েছে। ১৯৬৭ সালে কংগ্রেসে স্বজনপ্রীতি-বিরোধী একটি আইন পাস হয়। এর ফলে প্রেসিডেন্টরা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের কোনো কার্যালয় বা সংস্থায় নিযুক্ত করতে পারেন না। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি তার ভাই রবার্ট কেনেডিকে অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগের পরই এ আইন পাস হয়। শুক্রবার নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, প্রশাসনে আনুষ্ঠানিক পদ পাওয়ার কোনো উপায় আছে কিনা, তা জানতে ইতিমধ্যে আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন কুশনার। তবে এ ক্ষেত্রে আগ্রহটা ট্রাম্পেরই বেশি। এমন পদ পান আর না পান, অবেতনভোগী পরামর্শক বা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করতে তার কোনো বাধা নেই। এ নিয়ে খুব কম মানুষেরই সন্দেহ আছে যে, কুশনার ট্রাম্পের শাসনামলে বেশ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। পলিসি অ্যাডভাইজার বা গেট কিপারের দায়িত্ব তার কাঁধেই থাকবে। গত সপ্তাহে ওবামার সঙ্গে ট্রাম্প সাক্ষাৎ করতে হোয়াইট হাউসে গেলে কুশনারকে দেখা যায় ওবামার চিফ অব স্টাফের সঙ্গে গভীর আলোচনায় মগ্ন থাকতে। ওবামার এক সহযোগীকে তিনি জিজ্ঞেস করছিলেন, বর্তমান কর্মীদের কয়জন থেকে যাবেন? তার হয়তো জানা নেই, নিয়মানুযায়ী ওবামার সঙ্গে তার পুরো কর্মীদলই হোয়াইট হাউস ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু কে থাকবে, আর কে থাকবে না, এ নিয়ে তার আগ্রহ লক্ষণীয়। ইতিমধ্যে সাবেক জাঁদরেল পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ও মিডিয়া মুঘল রুপার্ট মার্ডকের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছেন তিনি। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। ট্রাম্পের মতো, সরকারি কোনো দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা তারও নেই। কিন্তু দৃশ্যত, যাদের এমন অভিজ্ঞতা আছে, তাদের চেয়েও তিনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন। (গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল ও হারেৎস অবলম্বনে)
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.