নোবেল বিজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক আবার চাঙা হয়েছে। গত তিন বছর মুনাফা কমার পর চলতি বছরের শুরু থেকেই পরিস্থিতি বদলেছে। মুনাফা আবার বাড়ছে। ২০১৬ সালের প্রথম ছয় মাসেই (জানুয়ারি-জুন) নিরীক্ষা ব্যয় বাদে ব্যাংকটি ৮৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা মুনাফা করেছে, যা আগের দুই বছরের মোট মুনাফার প্রায় দ্বিগুণ। ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদ থেকে সরে যাওয়ার পরের বছরওÜ ১৪৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল গ্রামীণ ব্যাংক। এর পরের তিন বছর মুনাফা ক্রমাগত কমেছে। যেমন ২০১৩ ও ২০১৪ সালে মুনাফা ছিল যথাক্রমে ১৩৩ কোটি ও ৪৩ কোটি টাকা। তবে ২০১৫ সালে তা প্রায় আড়াই কোটি টাকায় নেমে আসে, যা বিগত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। গ্রামীণ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে ড. ইউনূস এমডির দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার আগের তিন বছরে (২০০৯-২০১১) গ্রামীণ ব্যাংক ভালোই মুনাফা করেছিল। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা হয় ৬৮ কোটি টাকা। এর আগের দুই বছরে এর পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৭৫ কোটি ও ৩৭ কোটি টাকা। ড.¯ ইউনূস ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালেই ২০০৫ সালে প্রথমবারের মতো ১০০ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল গ্রামীণ ব্যাংক। ২০০৬ ও ২০০৮ সালেও শত কোটি টাকার বেশি মুনাফা হয়। তাঁর আমলে মুনাফা কোনো বছর কমলেও পরের বছর বেড়েছে। কিন্তু কখনো টানা তিন বছর মুনাফা কমেনি। চলতি বছর নানা সময়ে মুহাম্মদ ইউনূস আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে গ্রামীণ ব্যাংকটির কর্মীদের নানাভাবে উৎসাহ দিয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছেন। সর্বশেষ গত ২২ ও ২৩ জুলাই মিরপুরের গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী ষাণ্মাসিক আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে তিনি ব্যবস্থাপকদের উদ্দেশে বক্তব্যও দেন। এর আগের দুটি সম্মেলনেও তিনি বক্তব্য দিয়েছেন। ২০১১ সালের পর প্রায় তিন বছর এ সম্মেলন বন্ধ ছিল। এ সম্মেলনে সাধারণত পরবর্তী ছয় মাসে ব্যাংকের মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন কার্যক্রমের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গ্রামীণ ব্যাংক সূত্র বলেছে, খেলাপি ঋণ আদায় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই তিন বছর পর গ্রামীণ ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে ৫৩ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে, যা সরাসরি ব্যাংকের আয়ে যুক্ত হয়ে মুনাফা বাড়িয়েছে। এমনিতে ব্যাংকটির ঋণ আদায়ের হার ৯৮ শতাংশের বেশি। আবার এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই প্রায় পৌনে ছয় লাখ নতুন সদস্য হয়েছেন। তাঁদের প্রায় শতভাগই নারী। গত জানুয়ারি-জুন সময়ে ৪০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের (জোন অফিস) মধ্যে ৩১টি মুনাফা করেছে। ২ হাজার ৫৫৪টি শাখার মধ্যে ২ হাজার ৩০টি শাখা মুনাফা করেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ৭৯ শতাংশ শাখা এখন লাভজনক। সারা দেশে ঋণের স্থিতি প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। *আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক সম্মেলনে বক্তব্য দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস * স্থায়ী এমডি ও পূর্ণাঙ্গ পরিচালনা পর্ষদ নেই এদিকে পাঁচ বছর ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের স্থায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক নেই। চেয়ারম্যান থাকলেও তিন বছর আগেই তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তারপরও ঋণ বিতরণ, আমানত সংগ্রহ, নতুন সদস্য নেওয়া—এসব কাজ ঠিকভাবেই চালিয়ে নিচ্ছেন ব্যাংকটির মাঠপর্যায়ের কর্মীরা। এতে গ্রামীণ ব্যাংকের মাঠপর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে তেমন প্রভাব পড়েনি। সম্প্রতি ময়মনসিংহ জেলায় গিয়ে দেখা গেছে, প্রত্যন্ত গ্রামে আগের মতোই প্রতি সপ্তাহেই ‘কেন্দ্র’ বসে। গ্রামীণ ব্যাংকের সব কার্যক্রম এ কেন্দ্রকে ঘিরেই। এখানে সদস্যরা ঋণের কিস্তি ও আমানতের অর্থ জমা দেন। এ জন্য প্রত্যেক সদস্যকে প্রতি সপ্তাহেই একবার কেন্দ্রে যেতে হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের সারা দেশের মোট ১ লাখ ৪২ হাজার ২৭৩টি কেন্দ্রে সপ্তাহে এক দিন নিয়ম করে এ ধরনের সভা বসে। গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য ও কর্মীদের মধ্যে এ ধরনের নিয়মিত যোগাযোগই ব্যাংকটির কার্যক্রম স্বাভাবিক রেখেছে। কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করা হয় শাখার মাধ্যমে। আর আড়াই হাজারের বেশি শাখা পরিচালিত হয় ৪০টি আঞ্চলিক কার্যালয় বা জোন অফিসের মাধ্যমে। বিগত বছরগুলোতে মুনাফা হ্রাস-বৃদ্ধি সম্পর্কে গ্রামীণ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক রতন কুমার নাগ প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় বেতন স্কেলের অনুসরণে বেতন স্কেল বাস্তবায়ন; রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গত কয়েক বছরে মুনাফা কমেছে। এ ছাড়া ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি পরিচালনায় তদারকি খরচ অনেক বেশি। এসব পরিস্থিতি সামাল দিতে আদায়যোগ্য ঋণ ও সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি, মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ হ্রাস, স্বল্প সুদের আমানত সংগ্রহ, কু-ঋণ আদায় ইত্যাদি কর্মসূচি নেওয়া হয়। এর ফলেই ২০১৬ সালে সুফল পাওয়া শুরু হয়। ২০১১ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ২০১৪ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন মোহাম্মদ শাহজাহান। গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক বছরে গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর দিয়ে যে টর্নেডো গেছে, তাতে সবাই এ ব্যাংকটির ক্ষতির আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের কাঠামো ও কর্মীদের দক্ষতার কারণে তা হয়নি। ঋণ কার্যক্রম বেড়েছে: গত পাঁচ বছরে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। চলতি বছরের জুনে গ্রামীণ ব্যাংকের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এর পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। বছরওয়ারি ঋণ বিতরণের পরিমাণ পাঁচ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৫০ শতাংশের মতো। ২০১১ সালে ১০ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে ঋণ বিতরণ করা হয় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই ৯ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ হয়েছে। চলতি বছরের জুনের হিসাবে গ্রামীণ ব্যাংকের সার্বিক ঋণ আদায় হার ছিল ৯৮ দশমিক ৮১ শতাংশ। ভারপ্রাপ্ত এমডি রতন কুমার নাগ প্রথম আলোকে বলেন, শুধু বিশেষ কোনো অঞ্চলে নয়; সারা দেশেই গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে চলেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং সব সহকর্মীর আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে এ অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। উল্লেখ্য, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ১ হাজার টাকা ঋণ নিলে প্রতি সপ্তাহে সুদসহ ২৫ টাকা কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। আর ৪৪ কিস্তিতে তা পরিশোধ করেন সদস্যরা। সেই হিসাবে প্রতি হাজারে সুদসহ মোট ১১০০ টাকা পরিশোধ করেন তাঁরা। এর মধ্যে ১০০ টাকা সুদ। চাঙা হচ্ছে কর্মকাণ্ড: সরকারি হস্তক্ষেপসহ নানা কারণে প্রায় তিন বছর (২০১২ থেকে ২০১৪ সাল) ষাণ্মাসিক আঞ্চলিক ব্যবস্থাপকদের সম্মেলন হয়নি। ২০১৫ সাল থেকে আবার এ সম্মেলন শুরু হয়েছে। গত দেড় বছরে তিনটি সম্মেলন হয়েছে। এ সম্মেলনে ৪০ জন আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক, নিরীক্ষা কর্মকর্তাসহ গ্রামীণ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন। ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করে রাজধানীতে চলে এসেছেন, এমন সদস্যদের আবার ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সর্বশেষ ব্যবস্থাপক সম্মেলনে। এসব সদস্যকে গ্রামীণ ব্যাংকে ফিরিয়ে নিতে কয়েকটি দল গঠন করেছে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়। এ ছাড়া ব্যাংকের নারী সদস্যরা পল্লীফোন ব্যবহার করে যে বিল পরিশোধ করেন, এর ওপর কমিশন পান গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মীরা। মাঝে কিছুদিন সেই কমিশন বন্ধ থাকলেও আবার পাচ্ছেন তাঁরা। সরকার ঘোষিত নতুন বেতন স্কেল গত জুলাই থেকে গ্রামীণ ব্যাংকে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ব্যাংক সূত্র বলেছে, এতে এ বছর ৪৫০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে। এ ছাড়া নববর্ষ ভাতাও চালু করা হয়েছে। পৌনে দুই বছর পূর্ণাঙ্গ পর্ষদ নেই: প্রায় পৌনে দুই বছর ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ পর্ষদ নেই। চেয়ারম্যানসহ সরকারের মনোনীত তিন সদস্যের পাশাপাশি নির্বাচিত নয়জন নারী সদস্য বা পরিচালক নিয়েই গ্রামীণ ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ পর্ষদ। পদাধিকারবলে এমডি বোর্ডের সদস্য। পূর্ণাঙ্গ পর্ষদের সর্বশেষ সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর। ২০১৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচিত সদস্যদের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। ২০১৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক আইনে পরিচালনা পর্ষদের কোরাম-সংক্রান্ত সংশোধনী আনা হয়েছে। আইনের সংশোধিত ১৭(৩) ধারা অনুযায়ী, নির্বাচিত পরিচালকদের পদ শূন্য হলে পরিচালক নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত চেয়ারম্যান ও সরকার মনোনীত অপর দুজন সদস্য উপস্থিত থাকলেই সভার কোরাম হবে। এর আগে নির্বাচিত নারী সদস্যদের আপত্তিতে পূর্ণাঙ্গ পর্ষদ সভায় সরকার মনোনীত চেয়ারম্যান ও সদস্যরা একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। জানতে চাইলে গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক বোর্ড সদস্য তাহসিনা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন, পরিচালনা পর্ষদে তাঁদের অংশগ্রহণ ছাড়া কীভাবে চলবে? তৃণমূল থেকে উঠে আসায় গ্রামীণ ব্যাংকের সম্ভাবনা ও সমস্যা তাঁরাই বেশি জানেন। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত এমডি রতন কুমার নাগ বলেন, পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন এবং স্থায়ী এমডি নিয়োগের বিষয়টি সম্পূর্ণ সরকারের এখতিয়ার।