রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ফুলের মতো এক ফুটফুটে কিশোরী। দুই চোখ স্বপ্নহীন, ব্যথায় কাতর। এখন আর উঠতে বা বসতে পারে না সে। কখনও উঠে দাঁড়াতে পারবে কি-না, তাও অনিশ্চিত। অথচ ক’দিন আগেও কত রঙিন স্বপ্ন ছিল তার। স্কুলে যেতে যেতে, খেলতে খেলতে, সমবয়সীদের সঙ্গে হাসতে হাসতে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াত সে। বাবা দিনমজুর, মেয়ে তাই স্বপ্ন দেখেছিল পড়াশোনা শেষে চাকরি করে তাকে একটু স্বস্তি দেবে। কিন্তু তার সব স্বপ্ন হাসপাতালের বিছানায় ছটফট করছে। পিঠের ওপরের দিকে অনুভূতি থাকলেও শরীরের নিচের অংশ তার অনুভূতিহীন। বখাটের চায়নিজ কুড়ালের কোপে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেছে মেরুদণ্ড। চিকিৎসকরা বলছেন, তার স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশা একেবারেই ক্ষীণ।
অসহায় এই কিশোরীর নাম ফারজানা আক্তার মুনি্ন। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার সদর ইউনিয়নের উত্তর গড়িয়াইশ গ্রামের এই কিশোরীর ‘অপরাধ’_ সে ওই বখাটের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে মরিয়া তার দিনমজুর বাবা জাফর আহাম্মদ ও মা রিজিয়া বেগম। এরই মধ্যে তাদের খরচ হয়ে গেছে সাড়ে ছয় লাখ টাকা। শেষ সম্বল দেড় কাঠা ভিটে বিক্রি করেছেন তারা, সুদ দেওয়ার শর্তে ঋণ নিয়েছেন ২০ হাজার টাকা; প্রয়োজনে কিডনি বিক্রি করে দিতেও রাজি রিজিয়া। এই প্রতিবেদকের কাছে তিনি কাতরকণ্ঠে বলেন, ‘বাড়িঘর দিয়া কী অইব, আমার মাইয়াই যদি না থাকে? এখন যদি লাগে কিডনি বেচমু। দোয়া করেন, তাও য্যান মাইয়া বাঁচে।’
উপজেলার মিঠাছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে মুনি্ন। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে তাকে ত্যক্তবিরক্ত করত পাশের গ্রামের বখাটে মোজাম্মেল। দক্ষিণ গড়িয়াইশ গ্রামের শাহ আলমের বখাটে এই ছেলের প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় প্রথমে মুনি্নকে তুলে নেওয়ার হুমকি দেয় সে। তার ঔদ্ধত্যে-নির্যাতনে বাধ্য হয়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয় মুনি্ন। তবুও পরিত্রাণ পায়নি সে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য একাধিক মামলার আসামি ও দুশ্চরিত্র মোজাম্মেল এরপর তার বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। একপর্যায়ে তার দিনমজুর বাবা জাফর আহাম্মদের কাছে বিয়ের প্রস্তাবও পাঠায় সে। কিন্তু এমন সন্ত্রাসী বখাটের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হননি মুনি্নর মা-বাবা। ক্ষিপ্ত মোজাম্মেল এরপর তাদের উপর্যুপরি হুমকি দিতে থাকে_ অন্য কোথাও মুনি্নর বিয়ে হতে দেবে না সে, এই প্রত্যাখ্যানের পরিণাম হবে ভয়াবহ।
গত ২৬ জুন বেলা ১১টার দিকে কিশোরী মুনি্নর জীবনে সেই ভয়াবহ বীভৎস ঘটনাটি ঘটে। বাড়ির পাশের জমিতে কাজ করতে গিয়েছিল সে। পাশের জঙ্গলে ওঁৎ পেতে থাকা মোজাম্মেল তখন তার ওপর হামলে পড়ে। চাইনিজ কুড়াল দিয়ে একের পর এক কোপ বসাতে থাকে মুনি্নর মেরুদণ্ডের ওপর। সেই কোপের আঘাত এতই প্রচণ্ড ছিল যে, তার মেরুদণ্ড খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় পিঠের অনেক হাড়।
মুনি্নর খোঁজে সিআরপিতে : সাভারের সিআরপিতে চিকিৎসাধীন মুনি্নর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। কথা হয় তার মা রিজিয়া বেগমের সঙ্গে। তাদের দু’জনের চোখেই আতঙ্ক আর দুঃস্বপ্ন। মুনি্নকে দেখলে আর এ ঘটনার বিবরণ শুনলে যে কেউ আঁতকে উঠবেন। অনুভূতিহীন ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধী ছাড়া কারও পক্ষে এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। এরপর খণ্ডিত মেরুদণ্ড নিয়ে মুনি্ন আর ওই অসহায় দিনমজুর পরিবারটিকে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে বেড়াতে হয়। মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি চিকিৎসাকেন্দ্র ঘুরে মুনি্নর ঠাঁই হয়েছে সাভারের সিআরপিতে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সিআরপিতে সরেজমিন পরিদর্শনে যান এই প্রতিবেদক। পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের ৩৬ নম্বর বেডে শুয়ে আছে মুনি্ন। পাশেই মা রিজিয়া। সাংবাদিক পরিচয় পেতেই চোখ ছলছল করে ওঠে তাদের। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে ওয়ার্ড থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন তিনি। বলেন, ‘আমার মাইয়ার মুখে সব সময় হাসি লাইগা থাকত। স্কুলে যাইত। খেলত। সবসময় কইত পড়াশোনা শেষে চাকরি কইরবো। এহন সব শেষ অই গেছে। মাইয়া এখন বইতে পারে না। ঠিকমতো কথা কইতে পারে না। সারাক্ষণ কান্দে আর কয়_ এভাবে বাঁচি থাকনের চাই মরি যাওয়া ভালো। আমারে ইনজেকশন দিয়া মারি ফ্যালো। অরে আমি কী কমু কন? আমার বুক ফাইটে খালি কান্দন আসে।’ চোখ মুছতে মুছতে তিনি জানান, এ হাসপাতালে আসার পর পরিস্থিতির একটু উন্নতি হলেও শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা বলা যাচ্ছে না।
মুনি্নর চিকিৎসক সিআরপির হেড অব মেডিকেল সার্ভিস উইং ডা. সাঈদ উদ্দিন হেলাল বলেন, ‘কুড়ালের কোপে মুনি্নর মেরুদণ্ড দুই ভাগ হয়ে গেছে। পিঠের অনেকগুলো হাড়ও ভেঙে গেছে। আঘাতটি এত মারাত্মক যে, তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। পাঁচ মাস ধরে শুয়ে থাকায় ওর পিঠে ঘা হয়ে গেছে। বাইরে থেকে তাকালেই পিঠের মেরুদণ্ড এবং হাড়গোড় দেখা যায়। চেষ্টা চলছে এই ক্ষত শুকানোর।’ মুনি্নর চিকিৎসক বলেন, ‘পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে প্লাস্টিক সার্জারি করা হবে। তবে এই অবস্থা থেকে রোগীর উঠে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা মাত্র পাঁচ শতাংশ। চিকিৎসার পর মুনি্ন সর্বোচ্চ হয়তো হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে পারবে। তাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।’
ছোট বোনেরও স্কুল বন্ধ :মুনি্নর বাবা জাফর আহাম্মদ জানান, বখাটে মোজাম্মেল অনেক আগে থেকেই তার মেয়েকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। অনেকদিন নীরবে সহ্য করলেও তা মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে মুনি্ন নিজেই বিষয়টি পরিবারের কাছে জানায়। এরপর তিনি (জাফর) বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সমাজপতিদের কাছে যান। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। জাফর জানান, বখাটের হুমকি এবং মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়ায় মুনি্ন খুবই কান্নাকাটি করেছিল। কারণ ওর ইচ্ছে ছিল আরও লেখাপড়া করার। তবে ওর যেন ক্ষতি না হয়ে যায়, সেটি চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। মুনি্নর ওপর হামলার পর জাফর থানায় মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় মোজাম্মেল ফেরারি আসামি। অজ্ঞাত স্থান থেকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে সে। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জাফর বলেন, ‘মামলার পর পাঁচ মাস চলে গেছে। কিন্তু আসামি মোজাম্মেলকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারছে না! অথচ সে আমাদের হুমকি দেওয়া অব্যাহত রেখেছে।’
এদিকে দুশ্চিন্তার মেঘ জমছে আরেক মেয়ে রাবেয়া সুলতানাকে নিয়ে। বখাটে মোজাম্মেলের হুমকিতে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ূয়া রাবেয়ারও। মামলা তুলে না নিলে তার মেজ মেয়েকেও মুনি্নর পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে হুমকি দিচ্ছে সে। অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা হলেও রাবেয়া তাতে অংশ নিতে পারেনি। ক’দিন পর শুরু হবে বার্ষিক পরীক্ষা। সে পরীক্ষা দেওয়াও রাবেয়ার পক্ষে সম্ভব হবে না।
অভাবেও সুখ ছিল, এখন সুখও উধাও : তিন মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে সুখের সংসার জাফর-রিজিয়া দম্পতির। দিনমজুরি করে হলেও সংসার ভালোই চালাচ্ছিলেন জাফর। কষ্ট করে হলেও সন্তানদের মানুষ করতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। কিন্তু এক বখাটের কারণে তাদের সুখের সংসার এখন তছনছ হয়ে গেছে। গত জুন মাস থেকে পরিবারের সবাই খেয়ে না-খেয়ে কোনোমতে দিন কাটাচ্ছেন। চোখে ঘুম নেই রিজিয়া ও জাফরের। মেয়েকে বাঁচাতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। সংসারের প্রথম সন্তান বলে মুনি্নকে নিয়ে তাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। সেসব স্বপ্ন হারিয়ে গেলেও তারা চান মেয়ে যেন অন্তত সুস্থ হয়ে ওঠে।
সবাইকে মুনি্নদের পাশে দাঁড়াতে হবে :মোজাম্মেলের এই নৃশংসতা সম্পর্কে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘এই ফুটফুটে কিশোরীর ওপর যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, তা ধারণার বাইরে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই বখাটেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হবে না।’ মুনি্নর চিকিৎসাপ্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার কথা জানিয়ে গিয়াস বলেন, ‘চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে মেয়েটির পরিবার এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। আমাদের সবার উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। এমন বখাটেদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাও জরুরি।’
বেচতে হয়েছে শেষ সম্বল দেড় কাঠা ভিটে :ঘটনার পর থেকেই মুমূর্ষু মুনি্নকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটেছেন জাফর এবং রিজিয়া। রাতের পর রাত নির্ঘুম কেটেছে তাদের। রক্তাক্ত মেয়েকে জমি থেকে তুলে যখন হাসপাতালে যান, সঙ্গে কানাকড়িও ছিল না। বাধ্য হয়ে সুদে ঋণ নিয়েছেন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশিদের কাছ থেকে ধার করে টাকা নিয়েছেন। এলাকার লোকজনের কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছেন। কিন্তু তাতেও চিকিৎসা খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছিল না বলে শেষপর্যন্ত ভিটেমাটি পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে তাদের। মাথাগোঁজার জন্য ওই দেড় কাঠার ভিটেই ছিলো তাদের সর্বশেষ সম্বল।
জাফর জানান, এই পাঁচ মাসে মুনি্নর চিকিৎসার পেছনে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা খরচ হয়েছে তাদের। সুদ দেওয়ার শর্তে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তাকে সিআরপিতে ভর্তি করান তারা। গত ৬ নভেম্বর থেকে সিআরপিতে তার চিকিৎসা চলছে। সার্জারি এবং আরও বেশকিছু চিকিৎসা, ওষুধপথ্য বাকি আছে। কিন্তু হাতে নেই কানাকড়িও। মুনি্নকে বাঁচাতে তাদের সংগ্রাম তা হলে কি শেষ পর্যন্ত অর্থের কাছে হার মানবে?
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.