বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিরুপায় হয়ে কিউবার সঙ্গে পাটজাত পণ্য রপ্তানির সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। যদিও সে কারণে ফিদেল কাস্ত্রোর হাভানা ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কের কোনো টানাপোড়েন হতে দেয়নি। পাটজাত পণ্য বিক্রি করে কিউবার কাছ থেকে আমরা দুঃসময়ে ৫০ লাখ ডলার পেয়েছিলাম। আজ ফিদেলের পরলোকগমনের খবরে ভাবলাম, কিউবায় পাট রপ্তানি আমাদের ইতিহাসের একটা বিশেষ অধ্যায় হয়ে আছে। সেই গল্পটা বলি। কিসিঞ্জারই যে কলকাঠি নেড়েছিলেন, সেই সন্দেহ অল্প। তাঁর অপছন্দের তালিকায় থাকা মানুষের মধ্যে মুজিব যেমন, তেমনি কাস্ত্রো। কিসিঞ্জার কাস্ত্রোসহ গোটা হাভানাকে বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে মার্কিন আপত্তির অপ্রত্যাশিত বার্তাটি বাংলাদেশ সরকারের কাছে পৌঁছেছিল ২৭ মে ১৯৭৪ সালে। কিসিঞ্জারের সই করা তারবার্তায় দেখেছি, অবজারভার পত্রিকার ৪ মের রিপোর্ট থেকে তারা জানতে পারে, বাংলাদেশ কিউবায় পাট ও পাটের থলে রপ্তানি করছে। আর মার্কিন খাদ্যসহায়তা-সংক্রান্ত পিএল-৪৮০ আইন বলেছে, যারা কিউবার সঙ্গে ব্যবসা করে, তারা মার্কিন খাদ্যসহায়তা পাবে না। বাংলাদেশ জুট করপোরেশন ৫০ লাখ মার্কিন ডলারে ৪০ লাখ চটের থলে কিউবায় বিক্রি করেছে। কিন্তু টানা নয় মাস ধরে পিএল-৪৮০-এর অধীনে খাদ্যসহায়তা পাওয়ার জন্য চুক্তিপত্র তৈরির হোমওয়ার্ক চলেছে। ওই বিধানের বিষয়টি সরকার ছাড়াও ঢাকার মার্কিন দূতাবাস ও ইউএসএইড—কারও নজরে আসেনি বলে দাবি করা হয়েছে। তাই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই সেই সংবাদটি এসেছিল। কাস্ত্রোর দেশে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্য প্রেরণের শাস্তি হলো খাদ্যসাহায্য বন্ধ করে দেওয়া। নিক্সন-কিসিঞ্জারের জানা ছিল ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু মুজিবের ঘনিষ্ঠতার কথা। সাতপাঁচ না ভেবে যাঁরা বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, কাস্ত্রো তাঁদের পুরোধা। শুধু তা-ই নয়, তিনি আরও একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা ছিল বিরল। ফিদেল কাস্ত্রো খুব বড় ধরনের বাণিজ্যের সম্ভাবনা মাথায় রেখে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই নেননি। সেটা ছিল প্রতীকী। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি টের পেয়ে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে দুই-আড়াই লাখ টন খাদ্য দিতে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য করার অজুহাত দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে শাস্তি দিল। তবে এ বিষয়ে ঢাকার তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার সংকটকবলিত বাংলাদেশকে কষ্ট না দিতে তাঁর সরকারের কাছে দৃঢ়তার সঙ্গে যুক্ত তুলে ধরেছিলেন। এমনকি বোস্টার আইন বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন, কীভাবে ওই আইনের ফাঁক গলিয়ে বাংলাদেশকে খাদ্য দেওয়া সম্ভব। কারণ, বোস্টার লিখেছেন, সোভিয়েত ব্লক থেকে শেখ মুজিবকে দ্রুত বের করা সম্ভব নয়। তদুপরি মুজিব যা করছেন, তা আমাদের অনুকূলে রয়েছে। তাই বাংলাদেশের পিঠ দেয়ালে ঠেকানো সমীচীন হবে কি? বোস্টারের এই সহানুভূতিপূর্ণ তারবার্তাটি পড়ে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, তিনি যেন ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের অর্চার ব্লাড হয়ে উঠেছিলেন। বোস্টার বলেছিলেন, ওই আইনে কৃষিপণ্য বা তার কাঁচামাল যদি ‘অ-কৌশলগত’ হয়, তাহলে তা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে। আর পাটজাত পণ্য কোনো কৌশলগত পণ্য নয়। উপরন্তু আরও উপায় খোলা ছিল। নিক্সন ওই আইনের আওতায় একটা সনদ দিতে পারতেন। যাতে বলা সম্ভব ছিল, বাংলাদেশকে দেওয়া সাহায্য যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। মার্কিন কংগ্রেস তখন তাদের সরকারকে দায়মুক্তি দিত। মিসরও কিউবায় বাণিজ্য করেছিল। তারপর মিসরকে প্রেসিডেন্ট ফোর্ড ওই রকম সনদ দেয়। এ ছাড়া কিউবায় গাড়ি রপ্তানি করেছিল আর্জেটিনা ও ব্রাজিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মার্কিন সহায়তা পেতে তাদের সমস্যা হয়নি। বাংলাদেশ সেই উদাহরণ দেখাল। তখন পাল্টা যুক্তি দেখানো হয়েছিল, মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক সনদের আওতায় মার্কিন নাগরিক ও কোম্পানিগুলো কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য করতে ছিল। সেটা করা হয়েছিল এনিমি অ্যাক্টের অধীনে। আর বাংলাদেশ চাইছে পিএল-৪৮০ আইনের অধীনে। তাই বাংলাদেশকে খাদ্যসাহায্য দেওয়া যাবে না। এটা সুখের বিষয়, ফিদেল দেখে গেছেন, আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভর দেশ হয়েছি। কিসিঞ্জারের প্রশাসনের চাহিদা মেটাতে আমরা সেদিন মুচলেকা দিয়েছিলাম। বলেছিলাম কাস্ত্রোর কাছে পাট বেচব না। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই সিদ্ধান্ত তাঁকে জানাতে দারুণ মর্মপীড়ায় ভুগেছিলেন। কিন্তু তারপরও তিনি খাদ্যাভাবের কথা ভেবে সেই অপ্রীতিকর সিদ্ধান্ত কাস্ত্রোকে অবহিত করেছিলেন। কাস্ত্রো কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা অনুধাবন করেছিলেন। একজন মজলুম রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেই বঙ্গবন্ধুকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেছিলেন, বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করার কোনো প্রভাব দুদেশের ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্কে পড়বে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, সেটা ঘটেনি। ১৯৭৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন প্রশাসনকে জানিয়েছিল, ‘কিউবার বন্দরে বাংলাদেশের কোনো পতাকাবাহী জাহাজ যাবে না। সরকারের কোনো সংস্থাই কিউবায় কোনো ধরনের পণ্য রপ্তানির অনুমোদন পাবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমরা কাস্ত্রোকে অবাক করলেও তাতে নিক্সন-কিসিঞ্জারের মন গলেনি। তত দিনে দুর্ভিক্ষ বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আঘাত হেনেছে। এরপর নিক্সন প্রশাসন আরেকটি কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। এবারে অজুহাত খাড়া করা হলো, আইনের চোখে বাংলাদেশ এখনো কিউবার সঙ্গে ‘কারেন্টলি ট্রেডিং’ বা বাণিজ্য চলমান রাখা দেশ রয়ে গেছে। কারণ, রপ্তানি চুক্তি একটা হয়েছে। ক্রেতা টাকা দিয়েছেন। অথচ সেই চটের থলের ফরমাশের সবটা কিউবায় যায়নি। এর সব শেষ চালানবাহী জাহাজ বাংলাদেশের বন্দর ছেড়ে কিউবার বন্দরে নোঙর ফেলা না পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা চলতে থাকবে। তর্ক না করে পড়িমরি আমরা সব পাটের থলে কিউবাগামী জাহাজে চাপালাম। ওয়াশিংটনকে জানালাম শর্ত পূরণ করেছি, এবার খাদ্য দিন। তখন খাদ্যাভাবে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। কিউবার উদ্দেশ্যে শেষ জাহাজটি আমাদের উপকূল ত্যাগ করেছিল ’৭৪-এর অক্টোবরে। তত দিনে ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারিতে নিক্সনের পতন ঘটেছে। ৯ আগস্ট ১৯৭৪ নিক্সন পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু তখনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে রয়ে গেলেন তাঁরই দক্ষিণহস্ত হেনরি কিসিঞ্জার। কিন্তু বিষয়টি যে আইনি নয়, রাজনৈতিক ছিল, পরে সেটার আরও ঢের পরিচয় দিয়েছেন কিসিঞ্জার। বাংলাদেশ আজও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না যে কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন কি বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের মার্কিন আইনের খুঁটিনাটি জানাশোনার অভাবে ঘটেছিল? অথবা নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর সরকারকে অপছন্দ করত বলেই তারা একটা শিক্ষা দিয়েছে। ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ ওয়াশিংটন পোস্ট-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, খাদ্য পেতে বাংলাদেশের অযোগ্যতার বিষয়ে মার্কিন অবস্থান প্রকাশ পাওয়ার অল্প আগেই প্রেসিডেন্ট ফোর্ড মিসরকে ‘জাতীয় স্বার্থে’ দায়মুক্তি দিলেন। অথচ কায়রো হাভানার সঙ্গে বাণিজ্য করেছিল। ওয়াশিংটন তারপরও মিসরকে চার হাজার টন মার্কিন তামাক ও এক লাখ টন গম ক্রয়ে ঋণ দিয়েছিল ‘জাতীয় স্বার্থে’। বাংলাদেশকে পিএল-৪৮০-এর আওতায় খাদ্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছিল কিন্তু তত দিনে দুর্ভিক্ষ তার ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে। অধ্যাপক রেহমান সোবহানের মতে, খাদ্যসাহায্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে চাপ সৃষ্টি করেছিল, তারই ফসল ’৭৫ সালের পট পরিবর্তন। মার্কিন অর্থনীতিবিদ এমা রথচাইল্ড লিখেছেন, কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক রদ না করা পর্যন্ত মার্কিন খাদ্যবাহী জাহাজ বাংলাদেশে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। বিভিন্ন মার্কিন নথিতেও এই ভাষ্যের সমর্থন পেয়েছি। ১৪ আগস্ট ১৯৭৪ খাদ্য সরবরাহ প্রশ্নে কিসিঞ্জার যদিও সিনেটর হিউবার্ট হামফ্রের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘আমি বাংলাদেশের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল।’ কিন্তু তার প্রমাণ মেলে না। কাস্ত্রোর দেশে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্য রপ্তানির কারণে যে অজুহাত মার্কিনরা দেখিয়েছিল, তা যে লোক দেখানো ছিল, তার একটা প্রমাণ কিসিঞ্জারের নোটে আছে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭৫ কিসিঞ্জার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, পিএল-৪৮০-এর অধীনে ইন্দোনেশিয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশকে বাদ রাখুন। ১৩ মার্চ ১৯৭৬ কিসিঞ্জারের এক বার্তায় দেখলাম তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে আমরা আইনের ওই ধারা সংশোধন করেছি। এখন কিউবায় বাংলাদেশ পুনরায় রপ্তানি শুরু করলেও বাংলাদেশকে কৃষিপণ্য দিতে আর অসুবিধা হবে না।’ কিসিঞ্জারের চোখে কাস্ত্রো ও মুজিবের মধ্যে একটা মিল আছে। রজার মরিস মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে হেনরি কিসিঞ্জারের স্টাফ অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন। রজার মরিসের বর্ণনা অনুযায়ী, ‘কিসিঞ্জার মনে করতেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলি তাঁর জন্য একটি ব্যক্তিগত পরাজয়। একজন নির্বাসিত নির্যাতিত নেতা হিসেবে মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আমার বিবেচনায় একটি ট্যাংকে চেপে ফিদেল কাস্ত্রোর হাভানায় পৌঁছানোর পরে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির জন্য সব থেকে বিব্রতকর একক ঘটনা।’ অধ্যাপক অলিভার রুবিন ২০১২ সালে তাঁর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ফেমিন (রাউটলেজ) বইয়ে লিখেছেন, কমিউনিস্ট কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য করার অপরাধেই যুক্তরাষ্ট্র খাদ্য রপ্তানি স্থগিত করে বাংলাদেশকে শাস্তি দিয়েছিল।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.