নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সেভেন মার্ডার মামলার রায় ঘোষণার জন্য আগামী বছরের ১৬ জানুয়ারি তারিখ ধার্য করা হয়েছে। গতকাল বুধবার নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালতে সর্বশেষ ৩ আসামির আইনজীবী তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর এ মামলার রায় ঘোষণার জন্য ওই তারিখ ধার্য করা হয়। গতকাল আদালতে র্যাব-১১’র সাবেক কর্মকর্তা মাসুদ রানা, র্যাবের সাবেক সদস্য এএসআই বজলুর রহমান এবং সিপাহি আসাদুজ্জামান নূরের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যদিয়ে ৩৫ আসামির সবার পক্ষে আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন সম্পন্ন হলো। আসামিদের মধ্যে প্রধান আসামি নূর হোসেন, র্যাব-১১’র সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক কর্মকর্তা আরিফ হোসেন ও মাসুদ রানাসহ ২৩ জন কারাগারে। নূর হোসেনের ৪ সহযোগীসহ ১২ আসামি এখনও পলাতক। গতকাল আদালতে র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা মাসুদ রানার পক্ষে অসমাপ্ত যুক্তিতর্ক আদালতে উপস্থাপন করেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফরহাদ আব্বাস। এএসআই বজলুর রহমান ও কনস্টেবল আসাদুজ্জামান নূরের পক্ষে অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এদিকে সর্বশেষ ৩ আসামির পক্ষে আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সংশ্লিষ্ট আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ সব আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হয়েছে। তাই সব আসামির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড কামনা করছি। সেই সঙ্গে এই ঘটনায় যেসব ভিকটিমের পরিবার ও স্বজনরা অসহায়, ক্ষতিগ্রস্ত এবং দরিদ্র তাদের যেসব আসামিরা বিত্তশালী তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তার অর্থ নিহতদের পরিবারকে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানান। রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আরো বলেন, এ আদালতে গত এক বছর যাবৎ এ মামলাটি পরিচালিত হয়েছে। তিনি বিচারক এবং আসামিদের পক্ষে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সবার সহযোগিতায় মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ দ্রুততর হয়েছে। আসামি পক্ষের আইনজীবীদের মধ্য থেকে আদালতে বক্তব্য উপস্থাপন করেন, অ্যাডভোকেট খোকন সাহা। তিনি বলেন, এ মামলায় যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে ১০৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে সেজন্য বিচারককে তিনি আসামি পক্ষের সব আইনজীবীর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, আপনার মতো ২০ জন বিচারক দেশে থাকলে দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যালের প্রয়োজন হতো না। আসামি নূর হোসেনের পক্ষের এই আইনজীবী বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আরো বলেন, মহামান্য বিচারক জানি না মামলার নথিতে কী রয়েছে? তবে সার্বিক বিবেচনায় আপনি হয়তো আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা দেবেন, না হয় খালাস দেবেন। আপনি আমাদের অভিভাবক। আমরা আপনার কাছ থেকে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করি। এ প্রসঙ্গে খোকন সাহা বলেন, নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের চেয়েও আরো বড় ঘটনা ঘটেছে। ২০০১ সালের ১৬ই জুন নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলায় ২০ জন নিহত হয়েছিল। সেই মামলা এখনো বিচারের মুখ দেখেনি। অথচ মাত্র ১ বছরের মধ্যে চাঞ্চল্যকর ৭ খুন মামলার সাক্ষ্য গ্রহণসহ অন্যান্য কার্যক্রম যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে আপনি (বিচারক) সম্পন্ন করলেন তা অনন্য নজির হয়ে থাকবে। নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমিও আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। এটি একটি বড় মামলা। এত বড় একটি মামলা আপনাদের (আইনজীবীদের উদ্দেশ্য করে) সহযোগিতা ছাড়া সম্পন্ন করা কোনোভাবেই সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। আমার পক্ষ থেকে আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আদালতের স্বাভাবিক কাজ করার পর এত বড় মামলা পরিচালনা করা সত্যিকার অর্থেই কষ্টসাধ্য। এরপর তিনি মামলার রায় ঘোষণার জন্য আগামী বছরের ১৬ই জানুয়ারি তারিখ ধার্য করেন। তিন আসামির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন এদিকে গতকাল সর্বশেষ ৩ আসামির পক্ষে আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করেন আইনজীবীরা। এদের মধ্যে গতকাল র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা মাসুদ রানার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফরহাদ আব্বাস বলেন, মাসুদ রানার বিরুদ্ধে অভিযোগ অপহরণ ও লাশ গুম এবং আলামত গোপনে সহায়তা করা। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে প্রথম ঘটনাস্থল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে ৭ জনকে অপহরণের কথিত যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে করা হচ্ছে সেটি আসলে কোনো অপহরণের ঘটনা ছিল না। সেটি ছিল র্যাব-১১’র তৎকালীন অধিনায়কের নির্দেশে অপর একটি টিমকে সহায়তা করা। দ্বিতীয়ত তার বিরুদ্ধে আলামত গোপনের যে অভিযোগ আনা হচ্ছে তার মধ্যে ভিকটিমদের একটি গাড়ি যে চালক (নাজিম) সরিয়েছেন তাকে এই মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে। অপর গাড়িটি যে চালক (মিজান) সরিয়েছে তাকে এ মামলায় কোনো কিছুই করা হয়নি। লাশ ফেলার জন্য যে ট্রলার ব্যবহৃত হয়েছে সেটি মূলত অধিনায়কের নির্দেশে নদীতে টহল দেয়ার জন্য দেয়া হয়েছিল। আসামি এএসআই বজলুর রহমান এবং কনস্টেবল আসাদুজ্জামান নূরের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঘটনার দিন এএসআই বজলুর রহমান তথ্য সংগ্রহের জন্য র্যাব-১১’র ক্যাম্প থেকে সকালে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে বিকালে। কিন্তু অপহরণের ঘটনাটি ঘটেছে দুপুরে। ফলে আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত কর্মকর্তা কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে আদালতে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই আমি মামলা থেকে বেকসুর খালাস প্রার্থনা করছি। আদালতের সূত্র মতে, গত ৮ই ফেব্রুয়ারি আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চাজ গঠন করেন। ২৯শে ফেব্রুয়ারি থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। আসামিদের মধ্যে ২৫ জন র্যাব সদস্য ও ১০ জন নূর হোসেন ও তার সহযোগী। মামলায় মোট ১০৬ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন। ২০১৪ সালের ২৭শে এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লা থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম তার চার সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, সিরাজুল ইসলাম লিটন, তাজুল ইসলাম ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর এবং আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম। ৩০শে এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৬ জন ও ১লা মে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় দুটি মামলা করা হয়।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.