নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় আলাদা একটা গুরুত্ব বহন করছে এবারের নির্বাচন। হাইকমান্ডের নির্দেশে দুই দলের কেন্দ্রীয় নেতারা ছুটে আসছেন নারায়ণগঞ্জে। স্থানীয় নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করে প্রার্থীর পক্ষে নামানোই তাদের মূল লক্ষ্য। গতকাল আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে কেন্দ্রীয় ৫ নেতা জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তবে এর আগেই গত রোববার বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে কেন্দ্রের ৭ নেতা এসে দলের চেয়ারপারসনের মনোভাব স্থানীয় নেতাদের জানিয়ে গেছেন। গতকাল বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে নগর বিএনপি বর্ধিত সভা ডেকে দলের প্রার্থীকে জয়ে কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট অপু উকিল। অসীম কুমার উকিল সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, নারায়ণগঞ্জ মহানগরের নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। সবাই নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন। তিনি বলেন, আমরা আমাদের প্রার্থী নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাবো। তিনি বলেন, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে, হোটেল-রেস্তোরাঁয় চায়ের টেবিলে যে মুখরোচক গল্প ছিল সেই গল্পের অবসান হবে। আওয়ামী লীগে কোনো অনৈক্য নেই। মহানগর আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি চন্দন শীলের সভাপতিত্বে বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাত, শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শুক্কুর মাহমুদ, শ্রমিক উন্নয়ন ও কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাউসার আহমেদ পলাশ, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. আব্দুল হাই, সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদল, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দিপু, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা, সহ-সভাপতি রোকন উদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম আরাফাত ও মাহমুদা মালা প্রমুখ। সভায় সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন।
সাখাওয়াতের পক্ষে বিএনপির বর্ধিত সভা: নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে তার মামাতো ভাই যুবদল নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন মন্টি বলেছেন, সরকার দলীয় প্রার্থী দুর্নীতিবাজ। তার বিরুদ্ধে আমাদের প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানকে সহজেই জয়ী করে আনতে পারবো। বিগত দিনে আইভী সিটি করপোরেশনের সব উন্নয়নমূলক কাজ থেকে শতকরা ১০ ভাগ কমিশন নিয়ে টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছেন। তাই আমাদের বেগম জিয়ার মনোনীত প্রার্থীর জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। মোয়াজ্জেম হোসেন মন্টি ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর মামাতো ভাই। তিনি নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়কও। নগর বিএনপি সভাপতি জাহাঙ্গীর আলমের সভাপতিত্বে বর্ধিত সভায় উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপি সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার, বিএনপি নেতা আবদুল মজিদ, জামাল উদ্দিন কালু, এটিএম কামাল, অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন, অ্যাডভোকেট সরকার হুমায়ূন কবীর, হাজী শাহিন, রাশিদা জামাল, রহিমা শরীফ মায়া, সাজেদা খাতুন মিতা, নাসির উদ্দিন, যুবদল নেতা সরকার আলম ও মোয়াজ্জেম হোসেন মন্টি প্রমুখ। অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম বলেন, এখন প্রার্থীর দোষ-ত্রুটি বিচারের সময় নয়। আমাদের এক হাতে বেগম খালেদা জিয়া আরেক হাতে ধানের শীষ। তাই দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
নির্বাচিত হলে অবশিষ্ট কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা হবে: আইভী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেছেন, উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে কারো সঙ্গে আপস করিনি। নাগরিক সেবার মান বৃদ্ধির জন্য প্রত্যেক কর্মকর্তার কাজের খোঁজ নিয়েছি। কোথাও কোনো অনিয়ম হলে প্রতিবাদ করেছি এবং অনিয়ম দূর করেছি। আপনাদের শতভাগ নাগরিক সেবা প্রদান করার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়েছি, যা আপনাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান। এখনো অনেক কাজ চলমান রয়েছে। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টায় নাসিকের সিদ্ধিরগঞ্জের ৩নং ওয়ার্ডে ভোটারদের উদ্দেশ্যে তিনি এসব কথা বলেন। আইভী বলেন, আপনাদের সেবায় ৫টি বছর কাটিয়ে দিয়েছি। যেহেতু উন্নয়ন কাজ চলমান সেহেতু উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আপনাদের সহযোগিতা ও দোয়া চাই। নির্বাচিত হলে অবশিষ্ট কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা হবে। গণসংযোগকালে তিনি সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সকল শ্রেণি পেশার লোকজনের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করেন এবং উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য সকলের কাছে দোয়া প্রার্থনা করে নগরবাসীর সেবা করার সুযোগ চান। এ সময় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা লীগের নেতাকর্মীরা আইভীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। গণসংযোগের সময় বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় নারী পুরুষরা ফুলের পাপড়ি ছিটেয়ে, মালা পরিয়ে এবং ফুলের নৌকা উপহার দিয়ে তাকে বরণ করে নেন। মেয়র প্রার্থী আইভী ৩নং ওয়ার্ডের বাঘমারা, নিমাইকাশারী, মাদানীনগর ব্রিজ, আদর্শনগর, রসুলবাগ, নয়াআটি, মুক্তিনগর বটতলা মোড় হয়ে চিটাগাং রোড গিয়ে গণসংযোগ শেষ করেন।
আইভী ব্যস্ত ছিলেন শামীম ওসমানদের বিরোধিতায়: সাখাওয়াত ২০ দলীয় জোটের মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান তার প্রচারণায় দলের নেতাকর্মীদের বলেন, গত ৫ বছরে নগরীর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। কারণ, ওই ৫ বছর আইভী তার প্রতিপক্ষ শামীম ওসমানের বিরুদ্ধাচরণ করতেই ব্যস্ত ছিলেন। যে কারণে নগরীর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। গতকাল সকালে সাখাওয়াত হোসেন কুমুদিনী বাগান, দ্বিগুবাবুর বাজার, নিতাইগঞ্জ জিউড় আখড়া, ব্যাংক কলোনি, কিল্লারপুল এলাকায় গণসংযোগ করেন। বিকালে সিদ্ধিরগঞ্জের ২ নম্বর ওয়ার্ডে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন। এ সময় তিনি বলেন, দেশে যে দুঃশাসন চলছে তার বিরুদ্ধে জবাব দিতে আগামী ২২শে ডিসেম্বর ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ধানের শীষে ভোট দিতে হবে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমি উপলক্ষ মাত্র। ধানের শীষ প্রতীক বিএনপির। দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই প্রতীক দিয়ে পাঠিয়েছেন। তাই ধানের শীষের বিজয়ের জন্য সকলকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। গতকাল বিকালে সিদ্ধিরগঞ্জে মহানগরীর ২নং ওয়ার্ডে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। সভায় থানা বিএনপির সদস্য সচিব অধ্যাপক মামুন মাহমুদ বলেছেন, তৃণমূলে কোনো বিভেদ নেই। নেতাকর্মীরা দল ও দেশের স্বার্থে ত্যাগ স্বীকার করে আসছেন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও নিবেদিতপ্রাণ এই নেতাকর্মীরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত রয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মোল্লা সাখাওয়াত হোসেনের সভাপতিত্বে ওই মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সদস্য সচিব অধ্যাপক মামুন মাহমুদ, যুগ্ম আহবায়ক মনিরুল ইসলাম রবি, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক জাহিদ হাসান রোজেল, যুগ্ম আহ্বায়ক আকরাম প্রধান, রিয়াদ মোহাম্মদ চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন প্রধান, মহানগর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মমতাজ উদ্দিন মন্তু, জুয়েল প্রধানসহ স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা। আচরণবিধি লঙ্ঘনের মহোৎসব ওদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে আচরণবিধি লঙ্ঘনের মহোৎসব চলছে। প্রতীক বরাদ্দের আগেই প্রতীক নিয়ে গণসংযোগ, মিছিল, রাস্তা আটকে সভা সবই হচ্ছে। যদিও গতকাল শুক্রবার নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা তাদের সমর্থকদের নিয়ে গণসংযোগ করেছেন। তাদের সমর্থকরাও প্রতীক নিয়ে মিছিল করেছেন। এ বিষয়ে নাসিক নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার মো. নুরুজ্জামান তালুকদার জানান, প্রতীক বরাদ্দের আগে ঘরোয়াভাবে প্রার্থীরা উঠান বৈঠক ও মতবিনিময় করতে পারবেন। প্রকাশ্যে লোকজনের সমাগম ঘটিয়ে গণসংযোগ করার নিয়ম নেই। এটা আচরণবিধি লঙ্ঘন। শুক্রবার বিকালে নগরীর ২ নম্বর রেলগেট এলাকায় আইভীর সমর্থকরা বঙ্গবন্ধু সড়কের পশ্চিম পাশ দখল করে নৌকা ও আইভীর পক্ষে মিছিল করেন। খবর পেয়ে সেখানেও ম্যাজিস্ট্রেট পাঠান বলে জানিয়েছেন নূরুজ্জামান তালুকদার। আগামী ৫ই ডিসেম্বর নাসিক নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হবে। কিন্তু প্রতীক বরাদ্দের আগেই প্রার্থীরা গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন। ২৬ ও ২৭শে নভেম্বর মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের পর বৈধ প্রার্থীরা প্রচারণায় নেমে পড়ায় আচরণবিধির কোনো বালাই নেই। যে যার মতো আচরণবিধি লঙ্ঘন করে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। এলাকাবাসীর তথ্যমতে, গতকাল সকালে আইভী সিদ্ধিরগঞ্জে ৩ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগ করেন। ওই সময় সেখানে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে খবর পেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসনের এনডিসি জেসি প্রু ছুটে যান। তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে গিয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘনের কোনো আলামত পাননি। অপরদিকে বিকালে ২নং ওয়ার্ডে বিএনপির মেয়র প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান গণসংযোগ ও মতবিনিময় সভা করেছেন। এ সময় তাদের বিপুল সংখ্যক সমর্থকদের সমাগম ঘটে। গণসংযোগের সময় সমর্থকরা ধানের শীষের পক্ষে স্লোগান দেন। অন্যদিকে বিকাল ৪টার দিকে নাসিকের ১১নং ওয়ার্ডের বিতর্কিত প্রার্থী অহিদুল ইসলাম ছক্কু শতাধিক লোক নিয়ে খানপুর থেকে পায়ে হেঁটে হাজীগঞ্জ তল্লা এলাকায় গিয়ে গণসংযোগ করেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.