চার জঙ্গি ভোর পাঁচটায় স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ও গ্রেনেড নিয়ে উরিতে সেনা সদর দপ্তরে ঢুকে পড়ে। ওটা ছিল ‘চেঞ্জ অব কমান্ডের’ সময়। অর্থাৎ, এক দলের ডিউটি শেষ, অন্য দলের ডিউটি শুরু। অধিকাংশ সেনাই সে সময় তাঁদের ছাউনিতে ঘুমাচ্ছিলেন। আচমকা গ্রেনেড হামলা এবং এলোপাতাড়ি গুলিতে তাঁদের অনেকেই নিহত ও আহত হন। বেশ কয়েকটা ছাউনিতে আগুনও ধরে যায়। সেনাবাহিনী জানিয়েছে, আগুনে অনেকে পুড়ে গেছেন। ছয় ঘণ্টা লড়াই শেষে চার জঙ্গিই নিহত হয়। বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গোটা এলাকায় চিরুনি তল্লাশি চালানো হচ্ছে। খোঁজ চলছে আর কোনো জঙ্গি ওই চারজনের দলে ছিল কি না। সাতসকালেই এই জঙ্গি হানার খবর দিল্লিতে পৌঁছে যায়। গতকালই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা ছিল। এ ঘটনার পর সফর বাতিল করে দেন রাজনাথ। যোগাযোগ করেন জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ও রাজ্যপাল নরেন্দ্র নাথ ভোরার সঙ্গে। নিরাপত্তা নিয়ে জরুরি বৈঠক ডাকেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর এবং সেনাপ্রধান দলবীর সিংয়ের সঙ্গেও কথা বলেন রাজনাথ। পারিকর ও দলবীর সিং কাশ্মীরেই রয়েছেন। বৈঠক শেষে রাজনাথ বলেন, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র। তাদের সেভাবেই পরিচিত করে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। তিনি বলেন, জঙ্গিরা প্রত্যেকেই রীতিমতো প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতে ঢুকেছিল। রাজনাথ সিংয়ের এই অভিযোগের পরপরই এতে জড়িত থাকার অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তান। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাফিজ জাকারিয়া বলেন, এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটলেই পাকিস্তানকে দায়ী করা ভারতের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগে একাধিক হামলায় ভারতীয় সন্ত্রাসীরা জড়িত থাকলেও ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। পাকিস্তান সন্ত্রাসী রাষ্ট্র—রাজনাথের এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নাফিজ জাকারিয়া বলেন, ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্য ভারত এখন চেষ্টা করে যাচ্ছে। গত জুলাই থেকে কাশ্মীর অশান্ত। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদীনের তরুণ নেতা বুরহান ওয়ানি ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর কাশ্মীরে সহিংস বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভে এ পর্যন্ত ৮৫ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। মাত্র কদিন আগেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র বলেছিলেন, প্রায় ৩০ জনের একটি সশস্ত্র জঙ্গি দল নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতে ঢুকেছে। তারা বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে হামলার ছক কষছে। মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি গতকালের ঘটনা সম্পর্কে বলেন, স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, কাশ্মীরে একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তান রেষারেষিতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কাশ্মীরের। কাশ্মীরি জনগণ ছয় দশক ধরে ওই রেষারেষির মাশুল দিয়ে আসছে। আজ সোমবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হতে যাচ্ছে। ঠিক এ সময়েই কাশ্মীরে হামলার এ ঘটনা ঘটল। এই অধিবেশনে চির বৈরী দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান তুলে ধরবে। পাকিস্তান কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় তুলে ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে ভারত এই অধিবেশনে বেলুচিস্তানের প্রসঙ্গ তুলে ধরতে চায়। বেলুচ জনগণ পাকিস্তানের কাছে থেকে স্বাধীনতা চায়। এতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি প্রাধান্য দিতে চায় ভারত। ২০০২ সালে শ্রীনগর থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে কালুচকে সেনানিবাসে তিন জঙ্গি হানা দিয়েছিল। সেনাসদস্য ও তাঁদের পরিবারের ৩০ জন সেই আত্মঘাতী হামলায় মারা গিয়েছিলেন। তারপর উরির এই হামলায় এতজন প্রাণ হারালেন। গতকাল সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিহত জঙ্গিদের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্রে পাকিস্তানের ‘ছাপ’ রয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে চারটি একে-৪৭ ও গ্রেনেড। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এই গোষ্ঠীই ভারতের পাঞ্জাবের পাঠানকোটের বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায় বলে অভিযোগ করে আসছে ভারত। ওই হামলায় সাত ভারতীয় সেনা নিহত হন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লে. জেনারেল অসীম সালিম বাজওয়া বলেন, হামলার ঘটনার পর দুই দেশের সামরিক অপারেশন মহাপরিচালকেরা (ডিজিএমও) হটলাইনে নিয়ন্ত্রণরেখার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন। পাকিস্তানে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘ভারতীয় পক্ষের ভিত্তিহীন ও অপরিণত অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে পাকিস্তানের ডিজিএমও তাঁর ভারতীয় প্রতিপক্ষের কাছে এ বিষয়ে বাস্তব গোয়েন্দা তথ্য দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।’ জেনারেল অসীম বাজওয়া বলেন, সীমান্তের উভয় পাশেই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা থাকায় পাকিস্তান থেকে কাউকে ভারতে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।