নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দের পর উৎসবের আমেজে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারে নেমেছেন মেয়র ও কাউন্সিলর পদের প্রার্থীরা। এবারই প্রথম স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচন হচ্ছে দলীয় প্রতীকে। সাতজন প্রার্থীর মধ্য থেকে আগামী ২২ ডিসেম্বর ভোটাররা তাদের নতুন মেয়র বেছে নেবেন। নারায়ণগঞ্জের ভোটে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৫৬ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৩৭ জনের প্রার্থিতা বৈধতা পেয়েছে। সোমবার দুপুরে প্রার্থীদের সবার মধ্যেই প্রতীক বরাদ্দ করেছেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা নুরুজ্জামান তালুকদার।
দলীয় প্রতীকে ভোট হবে বলে স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র পদের প্রার্থীদের নিয়ে। গত মেয়াদে মেয়রের দায়িত্ব পালন করা সেলিনা হায়াৎ আইভীকেই নতুন মেয়াদের জন্য প্রার্থী করেছে আওয়ামী লীগ। তিনিই দলের প্রতীক ‘নৌকা’ নিয়ে লড়বেন। প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে প্রচারে নামার আগে আইভী সাংবাদিকদের বলেছেন, ভোটে জনগণ যে রায় দেবে, তা তিনি মেনে নেবেন। এ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আলোচিত সাত খুনের মামালায় বাদীপক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান। দলীয় প্রতীক ‘ধানের শীষ’ বরাদ্দ পাওয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নারায়ণগঞ্জের মানুষ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পেলে ‘পরিবর্তনের পক্ষে রায় দেবে’ বলেই তার বিশ্বাস। মেয়র পদের বাকি পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির মাহবুবুর রহমান ইসমাইল ‘কোদাল’, এলডিপির কামাল প্রধান ‘ছাতা’, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাসুম বিল্লাহ ‘হাতপাখা’, কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস ‘হাতঘড়ি’ এবং ইসলামী ঐক্যজোটের মুফতি এজহারুর হক ‘মিনার’ প্রতীক নিয়ে এ নির্বাচনে লড়বেন। এ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার অস্থায়ী কার্যালয় বসানো হয়েছে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে। সেখানেই প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এ সময় বাইরে ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়ে বলা হয়, কেবল প্রার্থী ছাড়া আর কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারবেন না। প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের ভিড়ে বাইরের বঙ্গবন্ধু সড়ক তখন প্রায় লোকারণ্য। প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর প্রার্থীরা মার্কা হাতে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে মিছিল করে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু করেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আইভীকে একটি হুড খোলা গাড়িতে চড়ে সমর্থকদের উদ্দেশে হাত নাড়তে দেখা যায়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক জাসদও নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছিল। পরে জোটের সিদ্ধান্তে আইভীর সমর্থনে মনোনয়নপত্র ?প্রত্যাহার করে নেন জাসদের মোসলেম উদ্দিন। অন?্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক কল্যাণ পার্টিও এ নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে। ‘হাতঘড়ি’ বরাদ্দ পাওয়ার পর এ দলের প্রার্থী রাশেদ ফেরদৌস সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জোটে সমন্বয়হীনতার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘২০ দলীয় জোট বিএনপির প্রার্থীকে সমর্থন দেয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমি অবশ্যই তাতে শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের ছিল তারা গাফিলতি করেছে। তারা আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। বিএনপির প্রার্থী এখন পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি। এজন্য আমার দলের সাধারণ সম্পাদকও দায়ী। তিনি আমাকে এ বিষয়ে কিছু জানাননি। তিনি জোট ও দলের ক্ষতি করতে চান, আমারও ক্ষতি করতে চান।’
গণরায় মেনে নেব: আইভী এদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ভোটে মানুষ যে রায় দেবে, তা মেনে নেয়ার কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী। সোমবার প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক প্রচারে নামার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন রাজধানীলাগোয়া এই সিটির সাবেক মেয়র। সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, আইভী নৌকা থেকে বিছিন্ন নয়, নৌকা আইভী থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। জনগণ আইভীর নাড়ির স্পন্দন। জনগণও আইভী ও নৌকা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সুতরাং আমরা একসঙ্গে, একযোগে কাজ করব। কেউ কারও থেকে ছোট বা বড় নয়। গণরায় অবশ্যই মেনে নেব। গণরায়ে যেটা হবে সেটাই মেনে নেব।’ নারায়ণগঞ্জে তাকে মনোনয়ন দেয়ায় তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা ‘নৌকা’য় রায় দেবে এমন আশা প্রকাশ করে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আইভী বলেন, ‘আশা করি নারায়ণগঞ্জের মানুষ দলমত নির্বিশেষে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে নারায়ণগঞ্জের উন্নয়নে আমাকে পুনরায় সুযোগ করে দেবে।’
ভোট সুষ্ঠু হলে জিতব: সাখাওয়াত অন্যদিকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ভোটাররা পরিবর্তনের পক্ষে রায় দেবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মেয়রপ্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন। সোমবার রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক প্রচারে নামার আগে এই প্রতিক্রিয়া জানান তিনি। সাখাওয়াত সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে নারায়ণগঞ্জের মানুষের মাঝে গণজোয়ার ও আবেগের সৃষ্টি হয়েছে। জনগণ এখন ভোট দেয়ার সুযোগ চায়। আমি যেখানেই যাচ্ছি, জনগণ সুষ্ঠুভাবে ভোট দেয়ার সুযোগ চায়। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেলে নারায়ণগঞ্জের মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে রায় দেবে। অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির করতে নির্বাচন কমিশনের কাছে আহ্বান জানান বিএনপির প্রার্থী। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা। কিন্তু এখনো সমান সুযোগ সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি হয়নি। আমি ইতোপূর্বে বলেছি লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড চাই। কিন্তু তা এখনো পাইনি।’ এক প্রশ্নের জবাবে সাখাওয়াত বলেন, ‘সরকার ও নির্বাচন কমিশন সব ব্যবস্থা নেবে- সেই আশা নিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মনোভাব কী তা যাচাইয়ের জন্য আমরা নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়েছি।’ সাখাওয়াত সাংবাদিকদের কাছে আবারও অভিযোগ করেন, আইভী কয়েকদিন ধরে আইন ভঙ্গ করলেও নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষে সিটি করপোরেশনের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নৌকা প্রতীক হাতে করে মিছিল নিয়ে প্রতীক নিতে এসেছেন। গত ৫-৭ দিন যাবত উনি (আইভী) আচরণবিধির কোনো তোয়াক্কাই করছেন না। তিনি অহরহ আইন ভঙ্গ করলেও নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সাখাওয়াত বলেন, ‘এই নির্বাচনের মাধ্যমে তো সরকারের পরির্বতন হবে না। সরকারি দলের প্রার্থী যত নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন তার প্রমাণ যদি দিতে যাই তাহলে আমি তো নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা করতে পারব না।’ বিধি লঙ্ঘনে ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ থাকলেও ‘সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা রেখে’ সব আইন-কানুন মেনেই নির্বাচনী প্রচারে থাকতে চান তিনি। নারায়ণগঞ্জের এই আইনজীবী বলেন, ‘আজ থেকে আমরা নির্বাচনী কার্যক্রম সব আইনকানুন মেনে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাব। জনগণের যে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়েছে, সেই গণতান্ত্রিক অধিকার জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার জন্যই নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাব।’ ধানের শীষের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে দাবি করে সাখাওয়াত বলেন, ‘আমি কারও ফেভার চাই না। আমি চাই সুষ্ঠু নির্বাচন। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে- তার চেয়ে বড় নিরাপত্তা বাহিনী বাংলাদেশের মানুষ ও সংবাদকর্মী মনে করি। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য সেই সুযোগটা আপনারা গণমাধ্যমকর্মীরা করে দেবেন- এটাই প্রত্যাশা।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.