বানরটাকে আনার পর থেকে সুলেমান আলী একটা অদ্ভুত সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কথাটা সে কাউকে বলতে পারে না। মাঝেমধ্যে তার ইচ্ছে করে বউকে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু ভরসা পায় না। বউটা এমনিতে বদমেজাজি। এসব ভাবসাবের কথা শুনলে তার মেজাজ আরও চড়া হবে। একদিন রাতের বেলা গঞ্জের মুদিদোকানটা পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পর থেকে সুলেমান বলতে গেলে রাস্তার ভিখিরি। কথায় কথায় বউ তাকে সে রকমই মনে করে কী সব বলে যায়। সুলেমান কানে শোনেও একটু কম। ছোটবেলায় অঙ্ক না বুঝে বাপের হাতে চড় খেয়েছিল। দুদিন বিছানায় কাৎ। তারপর থেকে সমস্যাটা। তবে কানে কম শোনাটা তার জন্য শাপেবর। বউয়ের হাঁকডাক থেকে কিছুটা হলেও দূরে থাকতে পারছে। বানরের রং যে এত সুন্দর সুলেমান জানত না। এমনিতে দেখেছে, দূর থেকে, একবার গ্রামের লোক একটা বানরের পেছনে পুরো একটা দিন লেগে ছিল। বানরটার উৎপাতে জীবন অতিষ্ঠ। তাকে গিয়ে মারা হলো গ্রামের সব থেকে কোনার বাড়িটার চালার ওপর। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মতো অবস্থা। তীর-বল্লম নিয়ে। তীর বেঁধা রক্তাক্ত বানরটাকে দূর থেকে একবার দেখেছিল সুলেমান, তখন তার গায়ের রং পরিষ্কার দেখা যায় না। লালে লাল হয়ে গেছে।
‘কী হইল, বান্দরের সামনে খাড়ায়া কী দেখতেছ! মনে হয় আয়নার সামনে খাড়ায়া রইছ?’
কথাটার মধ্যে যে একটা চোখা পিন আছে, সুলেমানের খুব লাগল। বউটা তার রূপদেমাগি, বিয়ের দিনই জেনেছে। ফকিরের ঘরের মেয়ে। কিন্তু জন্মেছে রাজকন্যার রূপ নিয়ে। বাসররাতে বউ যখন ঘোমটা খুলল, সুলেমানের চোখ ঘোলা। হায় হায়, এই পরিরে নিয়ে সে কী করবে! ওদিকে পরিরও ভিড়মি খাওয়ার মতো অবস্থা। চোখের সামনে একটা বান্দররে দেখে। এর সঙ্গে কীভাবে সংসার করবে সে!
এ কথা পরবর্তী জীবনে কম করে হলেও পাঁচ শ বার শুনেছে সুলেমান। বউয়ের মুখেই। কোনো প্রতিবাদ করেনি। প্রতিবাদ করারও জো নেই। সাত বছর গেল, নিজে যে ভালো দরের একটা প্রাণী, তারও প্রমাণ দিতে পারল না। ডাক্তার-কবিরাজ বাদ নেই। কিন্তু হয় না। কালা কুচকুইচ্যা ফকিরের ঘরের ফকির সুলেমান, এই সংকটেও দোষ গিয়া পড়ছে তার ওপরেই। গঞ্জের ডাক্তার বলে দিয়েছে সমস্যাটা তারই। সেটা শোনার পর থেকে তার প্রতি বউয়ের ভালোবাসা দয়ামায়া বেড়ে গেছে সাত গুণ। তার প্রমাণ এখন সুলেমানকে ঘুমাতে হয় খাটের কাছে, মাটিতে, একা।
‘বলছিলা না, মতলব মিয়ার কাছে যাইবা, একটা কাজের আলাপ আছে?’
সুলেমান বলতে চেয়েছিল, তার কাছে যাওয়ার কী দরকার? সে তো এমনেও আইব। বলতে পারে না।
‘চুপ আছো, বিষয় কী?’
‘বিষয় হইল, মতলব মিয়ার মতলব ভালো না, তার কাছে কাজের ফরিয়াদ নিয়া যাওয়ার ইচ্ছা করতেছে না। কারণ…কারণ…’
মনের ভেতর টনটন করা কথাটা কোনোমতে চেপে রাখে সুলেমান, একবার হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ায়।
‘আর শুনো, কালকের মইধ্যে বান্দরটারে ফালায়া দিয়া আসবা।’
‘কই ফালামু?’
‘গাঙ্গের পানিতে, জঙ্গলে, যেইখানে ইচ্ছা।’
‘এইটা কী কও!’
‘নাইলে যেখান থিকা নিয়া আসছ, সেইখানে রাইখা দিয়া আসবা। মামলা ডিসমিস।’
‘বউ, আমি তো ওরে নিয়া আসি নাই।’
‘তাইলে সে তোমার হাত ধইরা চইলা আসছে?’
‘আজব ঘটনা বউ!’—সুলেমানের চোখেমুখে গল্প ফাঁদার উচ্ছ্বাস, ‘পাহাড়ের মাঝখান দিয়া সাইকেল চালায়া আসতেছি, মনটা ক্যান জানি একটু উদাস হয়া পড়ছিল, প্যাডেলে পা পড়তেছে ঠিক চোখ নাই সামনে…’
‘চোখ কি তোমার আছে নাকি? দুইটা কুয়া!’
‘শুনো বউ, আসতেছি, আসতেছি, হঠাৎ কী জানি একটা, ভারী একটা কিছু, ঠিক অতটা ভারী না, এই ধরো মিডিয়াম, আইসা পড়ল ঠিক কান্ধের ওপর।’
‘ছি ছি বান্দরটা তোমার কান্ধের ওপর পড়ছিল? ওয়াক ওয়াক।’
‘শুনো না বউ, আসল ঘটনা তো তুমি শুনলাই না—’
‘টাইম নাই। বান্দরের কিসসা শুইনা সংসার চলব না।’
‘বউ! আজব ঘটনা। পয়লা খুব ভয় পাইছিলাম। সাইকেলসুদ্দা পইড়া গেলাম রাস্তার কিনারে। ভয়ে ডরে টাসকি খাইছি। পায়ে পাইলাম চোট। পরে কী আশ্চর্য! গর গর গর শব্দ কইরা পাশ কাইটা চইলা গেল বিশাল একটা ট্রাক। এক সেকেন্ড যদি দেরি করতাম, ট্রাকের তলায় একদম কাইত!’
এবার সুলেমানের বউ একটু নরম হয়। একবার বোধ হয় বানরটার দিকে তাকালও। বানর তখন একটা পাকা কলা খাচ্ছে। আর সুলেমানের বউয়ের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। তোমারে বিধবা হওনের হাত থিকা আমি বাঁচাইছি।
‘ও এমনে আমার ওপর পড়ে নাই বউ, আমারে নিশ্চিত অ্যাকসিডেন্ট থিকা বাঁচাইতেই—’
‘হইছে হইছে। এইসব হইল তোমার মনের বানাইন্যা হিসাব। তারপর কী করলা তুমি? বানরটারে কোলে কইরা বাড়িতে নিয়া আসলা?’
‘মাথা খারাপ? আমি তো তখন থ হইয়া বইসা আছি। বানরটা দেখি আমার লগ ছাড়ে না। সাইকেল নিয়া আসি, সেও লগে লগে আসে। একবার উইঠা পড়ল সাইকেলের হ্যান্ডেলে। ভয়ও লাগে। বান্দর নাকি চড়থাপ্পড় মারার ওস্তাদ। তাই ওর লগে বেশি দিগদারি করলাম না।’
হঠাৎ বানরটা চিঁ চিঁ করে হাততালি দিয়ে উঠল। সুলেমানের চমৎকার গল্পে সে একটা দারুণ চরিত্র, এই ভেবে বোধ হয় আনন্দিত।
‘আনছ আনছ, ভালো করছ, ওরে সাইকেলের ডান্ডায় উঠায়া কাল সক্কাল সক্কাল পাহাড়ের মাঝখানে ফালায়া দিয়া আসবা।’
‘বউ—’
‘আর একটা কথাও না।’
২.
মতলব মিয়া মোটামুটি বড় অঙ্কের একটা পুঁজি দিয়েছে সুলেমানকে। অবশ্য টাকাটা সুলেমানের হাতে নাই। বউ সব হ্যান্ডেলিং করছে। সুলেমান একবার জিজ্ঞেস করেছিল, কত টাকা? বউ বলে, ‘তুমি তো কানেও ভালো শুনো না, বিশরে শুনবা তিরিশ, তোমারে কয়া কী হইব?’
সুলেমানের অবশ্য শোনার তেমন আগ্রহ নাই। বানরের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে সে খালি ভাবে, মতলব মিয়া পুঁজি দিছে ঠিক কথা, কিন্তু সেই পুঁজি দিয়া তারা কী করব, কী কামে লাগাইব, বউ তো কিছু কয় না। দিন দুই-তিন পার হইল। বউ খালি রংচং মাইখ্যা ঘুইরা বেড়ায়। পায়ে নূপুর লাগায়, হাতে চুড়ি। আজ সকাল সকাল গঞ্জে গিয়া একা একা একটা হলদিয়া শাড়ি কিন্যা নিয়া আসছে। এত কালার থাকতে হলদিয়া ক্যান? তখন সুলেমানের মনে পড়ে, মতলব মিয়া তার খসখইস্যা গলায় প্রায় একটা গান করে, হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ, পাখিটি ছাড়িল কে…
পাখি তাইলে উড়াল দিছে। সুলেমানের মনটা খারাপ হয়ে যায়। যেদিন সুলেমানের দোকান পুড়ে ছাই হলো, মনে আছে সেদিনই মতলব মিয়া তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলেছিল, ‘আহা রে সুলেমান! পাখি তোমার উড়াল দিছে। কী করবা এখন?’
মতলব মিয়া রসিক মানুষ। চোরাচালানির ব্যবসা করতে করতে বস্তা বস্তা ট্যাকা বানাইছে, এখন সেই বস্তার ওপর বসে এসব রসের ইশারা-ইঙ্গিত করা তার চিত্ত-বিনোদন। মাথা সুলেমানের ভার হয়ে আসে। বানরটা হয়েছে পরাণের বান্ধব। অন্তরের সব কথা ঠিক ঠিক বুঝে নেয়। কী বুঝল কে জানে, সুলেমানের কাঁধে উঠে পড়ে। আরে আরে, কী করে! সুলেমানের মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে থাকে। বানরটার হাতে এমন মমতা, আপন বউয়ের হাতেও তা নাই। সুলেমানের চোখ ভিজে আসে।
সুলেমান গুনগুনিয়ে বানরের সাথে আলাপ চালায়, হাছা রে, বানর, (সুলেমান বান্দর বলে না, শুনতে খারাপ লাগে, সে বইয়ে পড়া শব্দ বানরই বলে ডাকে), তুই কি আসলেই আমাগো আগের বংশ? তাইলে তো তোর মন আছে, আমাগো মতোই, হুটহাট কইরা তো আর মন আইসা মাইনষের ভিতরে ঢুকে নাই, আস্তে আস্তে হইছে, আইচ্ছা তুই তাইলে আমাগো সব বুঝস? আমার সন্তান হয় না ক্যান রে, বানর?
(বানরটাকে আনার পর থেকে এসব চিন্তা নিয়েই একটা অদ্ভুত সমস্যার মধ্যে আছে সুলেমান, যা সে কারও কাছে বলতে পারে না।)
বানরের বিলি কাটতে অসুবিধা, হালকা করে একটা চড় বসায় সুলেমানের মাথার পেছনে। প্রথমে একটু ভড়কে যায় সুলেমান। কিন্তু বানরের আদর এখন সে বোঝে, তাই হাসে, ‘আহা রে বানর, বউয়ের আদর কী জিনিস, সেটাই বুঝলাম না আজতক!’ বানর চিঁ চিঁ করে। হাসল নাকি!
সুলেমান চুপচাপ বসে থাকে। বাড়ির ভেতরে চুড়ি-নূপুরের চ্যান চ্যান আওয়াজ। বউ কি মতলব মিয়ারে নাচ দেখাইতেছে নাকি? কই, নাচতে পারে বইলা তো শুনি নাই।
মতলব মিয়া এখন প্রায়ই আসে। তার দেওয়া পুঁজি নিয়ে কী ব্যবসা হবে তার আলাপ। সুলেমানের মনে হয় এ আলাপ জন্মের আলাপ। পুঁজি ফুরিয়ে যাবে, এ আলাপ আর শেষ হবে না। সুলেমানও খুশি। পুঁজির আলাপে মত্ত হয়ে বউ তার বানরের চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিয়েছে। এখন বলতে গেলে বানরের সঙ্গেই সুলেমানের ভাবের সংসার।
বানর তাকে চিমটি কাটল। সুলেমান এবার ব্যথায় খানিকটা কঁকিয়ে উঠল, এ্যাই এ্যাই, কী করস! করস কী তুই! বানর তার দিকে ক্যামন করে যেন তাকিয়ে থাকে। সুলেমান তার সেই ভাষা বুঝতে পারে না। শালার বানর, তার পূর্বের প্রজাতি, মানুষের সঙ্গে দুই-চার দিন থাকতেই ভাব বাড়িয়ে ফেলেছে দশ গুণ।
বানর ফের চিমটি কাটে। আর চোখে কী জানি ইশারা করে। এই বানরটার বহু ইশারা-ইঙ্গিত সে বুঝে নিয়েছে এত দিনে। কিন্তু আজকের এই ইঙ্গিত বড় অচিন লাগে সুলেমানের। বানর এবার তার গলার চিকন শেকলটার দিকে ইশারা করে। মানে কী? খুইলা দিতে কয়? না না! কার না কার ওপর গিয়া পড়ে, ক্ষেত গিরস্থি নষ্ট করে, আর মানুষের প্যাদানি খায়! না না! আমারে ভুল বুঝিস না রে, বানর। আমি তো দেখছি, মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হইতে পারে। বানরটারে একদম লালে লাল কইরা ফালাইছিল। তোরেও ওইভাবে…! চুপ থাক। আবার জোরে চিমটি কাটে বানর। চোখে তার করুণ অনুনয়।
কী করবে সুলেমান? ছেড়ে দেবে? বউ জানলে এবার তাকে নির্ঘাৎ ভিটাছাড়া করবে। ভিটা তো এখন বলতে গেলে বউয়েরই। সেখানে মতলব মিয়া এসে নিত্য নিত্য ঘুঘু চরায়। বানরটা মনে হয় দু-এক দণ্ড মুক্তি চায়। একটু স্বাধীন হয়ে চলাফেরা করতে চায়।
ভেতরে চুড়ি-নূপুরের ঝনঝন আওয়াজ। মতলব মিয়ার ধৈর্য্য আছে। এতক্ষণ ধইরা তালবেতাল নাচ দেখতে পারে!
সুলেমানের মনে বানরটার প্রতি এক ধরনের করুণা দ্রুত সাহসে রূপ নেয়। তার বাঁধন খুলে দেয়।
বানরটা তার সঙ্গে জোরে-বলে হ্যান্ডশেক করে। তারপর চিঁ চিঁ করে লাফ দিয়ে দ্রুত চলে যেতে থাকে। কই যায়! কই যায়!
বানরটা একদম ঘরের ভেতর। হায় হায়! কী করে! কী করে!
৩.
মতলব মিয়া এখন হাসপাতালে। বানরটা তার একটা কান ছিঁড়ে নিয়েছে। বাকি কানটাও যেত, তার আগেই মতলব মিয়া বানরের অলৌকিক ভাষা যেন বুঝতে পারে, আর সঙ্গে সঙ্গে কান্না জুড়ে দেয়, সুলেমানের পায়ে পড়ে। নিজে নিজেই স্বীকার করে যে সুলেমানের গঞ্জের দোকানে সে-ই আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল।
বানরটাও সুলেমানের সঙ্গে হাসপাতালে এসেছে। মতলবকে দেখতে। মতলবের দিকে তাকিয়ে সে মিটমিট হাসে। মতলবও তার সঙ্গে সৌজন্য হাসি বিনিময় করে। এই সবকিছু ঘটে সেই প্রাণবৈজ্ঞানিক কারণে: মানুষ তো আসলে বানরেরই প্রজাতি।
সুলেমান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপার আনন্দে এই সত্য নতুনভাবে উপলব্ধি করে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.