ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় কলেজশিক্ষকসহ দু’জনের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে দায়ী করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (জামাকন) তদন্ত কমিটি।
এতে বলা হয়, পুলিশের কঠোর হস্তে বিক্ষোভ দমন নীতির কারণেই ওই শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়, স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন ও তার ছেলে ইমদাদুল হক সেলিমের ওপর সাধারণ মানুষ প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। সংসদ সদস্য তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলে এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো যেত।
প্রতিবেদনে স্থানীয় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা মহাবিদ্যালয়কে সরকারি করার (জাতীয়করণ) সিদ্ধান্ত বহাল রেখে ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজকে সরকারি করার সুপারিশ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটি বুধবার কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে তাদের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে দাঙ্গা দমন করার ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের আরও সহনশীলতা প্রদর্শন ও পুলিশ সদস্যদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের সুপারিশ করা হয়েছে।
ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজ সরকারি করার দাবিতে আন্দোলনে ২৭ নভেম্বর শিক্ষকসহ দু’জনের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে জামাকন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
কমিটির প্রধান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন। সদস্য ছিলেন জামাকনের পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) এবং
অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. শরিফ উদ্দিন এবং জামাকনের সহকারী পরিচালক (অভিযোগ, পর্যবেক্ষণ ও সমঝোতা) জয়দেব চক্রবর্তী।
কমিটি সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্টদের সাক্ষ্য নেয়। বুধবার তারা কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
জামাকন চেয়ারম্যান ড. কাজী রিয়াজুল হক বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা প্রতিবেদনে তিনটি সুপারিশ করছি। আমরা বলেছি, ফুলবাড়িয়াতে শিক্ষকসহ দু’জনের মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। যৌক্তিক দাবিতে ছাত্র-শিক্ষকরা বিক্ষোভ শুরু করার পর পুলিশ কঠোর হস্তে (হাই হ্যান্ডেলনেস) দমন করে বলে প্রমাণিত হয়েছে। পুলিশ বিষয়টি আরও কৌশলী হয়ে মোকাবেলা করতে পারত। কলেজ সরকারি করার দাবিতে বিক্ষোভকারীরা হয়তো অ্যাগ্রেসিভ হয়েছিল। তারপরও পুলিশের আরও সহনশীলতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা উচিত ছিল। উত্তেজিত জনগোষ্ঠীকে যেভাবে বিশ্বাসের মধ্যে নিয়ে মোকাবেলা করতে হয় স্থানীয় সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে বিক্ষোভকারীদের উত্তেজনা কমেনি বরং এর পরিণতিতে শিক্ষকের প্রাণহানি হয়েছে।’
শিক্ষকের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যায়নি উল্লেখ করে রিয়াজুল হক বলেন, ‘শিক্ষকের মৃত্যুর জন্য সরাসরি কাউকে দায়ী করা হয়নি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্থানীয় প্রশাসন বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। আমি জামাকনের চেয়ারম্যান হিসেবে পুলিশপ্রধানসহ সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করব তারা যেন পুলিশবাহিনীকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেন। বেআইনি সমাবেশ বা দাঙ্গা দমনের কৌশল আইনে লেখা থাকলেও সেটা সঠিকভাবে পালন করা হয় না।’
জামাকন চেয়ারম্যান বলেন, ‘এবার আমাদের জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। আইনে বলা আছে, বেআইনি সমাবেশ দমনের জন্য প্রথমে মৃদু তারপর ভারি লাঠিচার্জ করবে। এতে দাঙ্গা দমন না হলে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে অনুমতিসাপেক্ষে ফাঁকা গুলি, এরপর আত্মরক্ষার্থে গুলি করা যাবে। কিন্তু এবার প্রথমটাতেই অর্থাৎ লাঠিচার্জেই শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। তাই লাঠিচার্জের বিষয়েও পুলিশকে সতর্ক থাকতে হবে।’
জামাকনের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ‘স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন ও তার ছেলে ইমদাদুল হক সেলিমের ওপর স্থানীয় মানুষ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিল। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাদের ওপর যে অর্পিত দায়িত্ব ছিল; সেটা সঠিকভাবে পালন করতে পারেননি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি (এমপি) তার দায়িত্ব পালন করতে পারলে এবং জনসাধারণকে তার আস্থায় নিতে পারলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটত না।’
প্রতিবেদনের সুপারিশ উল্লেখ করে ড. কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘আমরা কলেজটি জাতীয়করণের সুপারিশ করেছি। এ ক্ষেত্রে আমরা বলেছি দীর্ঘদিন থেকে সুনামের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত কলেজটিতে অনেক শিক্ষার্থী আছে সেটি যেমন গুরুত্ব পায়; তেমনি নারী শিক্ষার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া নারী শিক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। তাই ফুলবাড়িয়ার বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা মহাবিদ্যালয়কে সরকারি করার সিদ্ধান্ত যেটা হয়েছে তার বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। এ সরকার অনেক প্রতিষ্ঠান ও অনেক কলেজ সরকারি করেছে। আমরা চাই বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা মহাবিদ্যালয় নামে যে কলেজটি সরকারি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে সেই সিদ্ধান্ত বহাল রেখে ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজটিকে জাতীয়করণে অগ্রাধিকার দেয়া হোক।’
কারও দায়ভার চিহ্নিত করে শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘অভিযোগ এসেছে মূলত পুলিশের বিরুদ্ধে। তবে বিশেষ কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করা হয়নি। আমরা বলেছি, যারা এ কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হোক।’
ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজকে সরকারি করার দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২৭ নভেম্বর বিক্ষোভ করেন ছাত্র-শিক্ষকরা। এ সময় বিক্ষোভকারীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভে লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস ও গুলি (রাবার বুলেট) করে পুলিশ। এতে কলেজটির উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম (৫৫) ও স্থানীয় বাসিন্দা সফর আলী (৬০) নিহত হন।