আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দিনটি বড়ই শোকাবহ। একাত্তরের এই দিনে বাংলাদেশের ইতিহাসে সংযোজিত হয়েছিল এক কলংকজনক অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের প্রাক্কালে দখলদার বাহিনী ও তার দোসররা পরাজয় নিশ্চিত জেনে মেতে ওঠে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তারা হত্যা করে জাতির অনেক কৃতী সন্তানকে। এর আরেকটি বড় উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা লাভ করতে যাওয়া একটি জাতিকে মেধাশূন্য করা। ২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরুর পর থেকেই তারা গণহত্যার পাশাপাশি বেছে বেছে কিছু মানুষকে হত্যা করে- যারা বিবেচিত হতেন দেশের অসাধারণ নাগরিক হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের গোটা সময়টায় রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলা শহরে দেশীয় অনুচরদের সহায়তায় হত্যা করা হয় তাদের। তাদের ‘অপরাধ’ ছিল নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনসাধারণকে স্বাধিকারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলা এবং মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা জোগানো। প্রাণরক্ষা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে অনেক বুদ্ধিজীবী দেশত্যাগ করায় তারা রেহাই পান ওই হত্যাযজ্ঞ থেকে। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত ডিসেম্বর মাসে আমরা যাদের হারিয়েছি, নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের অধিকাংশই ছিলেন খ্যাতিমান। যুদ্ধে চারদিক থেকে কোণঠাসা হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা রাজধানীসহ মূলত শহরাঞ্চলে ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড চালায়। ন’মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাঙালির বিজয় অর্জনের ফলে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে এক স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। আমাদের জন্য তা ছিল মহত্তম অর্জন। কিন্তু বিজয়ের আনন্দ অনেকটাই বিষাদে পরিণত হয় লাখ লাখ সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কারণে। এসব বুদ্ধিজীবীসহ ৩০ লাখ শহীদ ও অসংখ্য নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি প্রিয় মাতৃভূমি। প্রতিবারের মতো এবারও জাতি আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর ওইসব মানুষকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। দাবি করবে তাদের হত্যার জন্য দায়ীদের বিচার। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত বেশ কয়েকজনের বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়েছে, কয়েকজনের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের দেয়া দণ্ডাদেশ কার্যকরও হয়েছে। একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি সম্মান দেখানোর উত্তম পথ হল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা। তবে পরিতাপের বিষয়, পাকিস্তানের সরকারসহ রাজনৈতিক মহল এই বিচার আজও মেনে নিতে পারেনি। তারা এ বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে নানা বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একাত্তরে এদেশে যে নজিরবিহীন বর্বরতা চালিয়েছে, এর জন্য পাকিস্তান সরকারের উচিত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এর পরিবর্তে তারা তাদের ও তাদের দোসরদের দ্বারা সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে ক্রমাগত ধৃষ্টতামূলক বক্তব্য প্রদান ও আচরণ করে যাচ্ছে। বস্তুত এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, একাত্তরে তাদের পরাজয় তারা মেনে নিতে পারেনি আজও।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.