স্যার দুইডা টাকা দেন না সারাদিন কিছু খাইনি। আমার মা দুইদিন ধরে অসুস্থ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যামু, ও স্যার দেননা দুইডা টাকা পিছন থেকে জামা ধরে টানে। আবার কখনও পা ধরে টানাটানি। এভাবেই বিভিন্ন হৃদয়স্পর্শী কথা বলে পিছু নেয় ভদ্র বাবুদের। সমাজের মানুষেরা অনেক সময় ঘৃণায় তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আঁখি, সুমন, সুমাইয়া, রবিন, হালিম, রেজিয়া, মিম, রাকিন। এরা সবাই পথশিশু। যে সময়টা তাদের লেখাপড়া করার কথা, আনন্দে হৈ-উল্লাস করার কথা ঠিক সে সময়টাই তারা রাস্তায় কাটায়। এরা সবাই দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, শ্রমিক, সবজি বিক্রেতা, গৃহপরিচারিকা, ভিক্ষুকের সন্তান। ইট পাথরের এই চমকপ্রদ শহরের রঙিন পর্দার অন্তরালে এরকম হাজার হাজার শিশু ঘুরে বেড়াচ্ছে অনাহার অবহেলা, অনাদর আর নির্যাতনে। আর এরকমই পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে অনেক বেসরকারি সংগঠন। তাদেরই একটি হলো পথশিশু সেবা সংগঠন। পথশিশু সেবা সংগঠন একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। ‘আসুন নিজে সেবা করি এবং অন্যজনকেও সেবা করার সুযোগ করে দিই’ এই স্লোগান নিয়ে আজ থেকে সাত বছর আগে ২০০৭ সালের ২৭ এপ্রিল পথশিশু সেবা সংগঠন রেজাউল করিম খোকন ও ইটালিয়ান নাগরিক ব্রাদার লুসিওর হাত ধরে ঢাকার রাজপথে যাত্রা শুরু করে। সংগঠনটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। স্বেচ্ছাসেবীদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে রাজপথে থাকা শিশুদের কষ্ট উপলব্ধিকে কেন্দ্র করে সংগঠনটির সূচনা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার এবং বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সমন্বয়ে গঠিত এই সংগঠনে নিয়মিত ৭০ জন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করেন। অনিয়মিতভাবে আরো ৩৬০ জন জড়িত আছেন। কোনো প্রকার আর্থিক অনুদান ছাড়াই স্বেচ্ছাসেবীদের অর্থায়নে চলে পথশিশু সংগঠন। ভালোবাসার মাধ্যমে মানবতাবোধ তৈরি করা, শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করা এ সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য। রাজধানীর কাওরানবাজার, নিউ মার্কেট, গাবতলী বাস টার্মিনাল, কমলাপুর রেল স্টেশন, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে সপ্তাহে একদিন করে দুই ঘণ্টা সেবা প্রদান করে থাকে এই সংগঠনটি। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে ১১টা, কমলাপুর রেল স্টেশন শুক্রবার, বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে সাড়ে ৫টা, কাওরানবাজার ওয়াসা ভবনের সামনে শনিবার বিকাল সাড়ে তিনটা থেকে সাড়ে ৫টা, গাবতলী বাস টার্মিনাল রাজা-বাদশা কাউন্টারের কাছে, মঙ্গলবার বিকাল ৩টা থেকে ৫টা, নিউ মার্কেটের ছাদে, বুধবার বিকাল সাড়ে তিনটা থেকে সাড়ে ৫টা। এক একটি ফিল্ডে ৯ জন করে স্বেচ্ছাসেবী কাজ করেন। তাদের মধ্যে একজন লিডার, সঙ্গে আরেকটা ভাইস লিডার থাকেন। উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, মানসিক ও শারীরিক খেলাধুলা, প্রাথমিক চিকিৎসা, ছবি আঁকা, শিশুবান্ধব কার্টুন, সিনেমা, নাটক, ভালো খাবার-দাবার, ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৬ই ডিসেম্বর, পথশিশু দিবস, ১লা বৈশাখ, ঈদ, চিড়িয়াখানা ভ্রমণ, শিশুপার্কে নিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে পথশিশুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করে। তারাও যে এই সমাজের অংশ, মানুষ হিসেবে তাদেরও গুরুত্ব আছে। তাদের সুপ্ত প্রতিভাকে খুঁজে বিকশিত করার জন্য তারা সহযোগিতা করে। সর্বোপরি বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে পুনর্বাসনের মাধ্যমে পথশিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণে সহায়তা করে। পথশিশু সেবা সংগঠনের অন্যতম স্বেচ্ছাসেবী রেজাউল করিম খোকন জানান, মূলত এই সংগঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পুনর্বাসনের উপযোগী করে তোলা। তাদের মানসিকভাবে উজ্জীবিত করা। তিনি বলেন, তাদের পড়ালেখা শিখিয়ে শিক্ষিত করে তোলার সামর্থ্য আমাদের নেই। কিন্তু আমরা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি মাধ্যমে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি। তারা রাজি হলে আমরা তাদেরকে উপযুক্ত আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠাই। এক্ষেত্রে আমরা পথশিশু ও আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করে থাকি। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে পথে যেন কোনো শিশু না থাকে। এ লক্ষ্যে আমরা ২০০৭ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.