ঘর ঘর ভর ভর শব্দ। মেঘের মতো কালো ধোঁয়া নির্গমন। ঝনঝন করে ছুটে চলা মুড়ির টিন মার্কা পরিবহনের কথা মনে আছে হয়তো অনেকেরই। বহু বছর পার হয়েছে। শত শত কোম্পানির গাড়িও যোগ হয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে। তবে মুড়ির টিন মার্কা গণপরিবহনের যন্ত্রণা রয়েই গেছে। রাস্তায় বের হলেই চোখে পড়ে লক্কড়ঝক্কর যানবাহন। কোনোটির রঙ চটা, কোনোটির ছাল ওঠা। কোনোটির গ্লাস ও জানালা ভাঙা, কোনোটার আবার দরজাই নেই। কিছু বাসের বাইরের রঙ ঠিক থাকলেও আসনগুলোর করুণ অবস্থা। সিট ভাঙা আর ছাদ দিয়ে পানি পড়াসহ বিভিন্ন ধরনের ত্রুটিযুক্ত গণপরিবহনে সয়লাভ রাজধানী। এ যেন মুড়ির টিনের শহর। ফিটনেসবিহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহনে চলাচল যেমন বিপজ্জনক। একইভাবে এসব লক্কড়-ঝক্কর গাড়ি নগরীর সৌন্দর্য বিনষ্ট করছে। গত কয়েক দিনে রাজধানীর গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, গাবতলী এবং উত্তরা রুটে সরেজমিনে গিয়ে এমনই দৃশ্য চোখে পড়ে। লোকাল সার্ভিস, সিটিং সার্ভিস এমনকি টিকিট সার্ভিসের গাড়িতেও একই অবস্থা। চোখ মেললেই চারদিকে লক্কড়-ঝক্কর গাড়ির ছড়াছড়ি। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা শহরে মোট নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ১০ লাখ ৫০ হাজার ১২৪টি। এর মধ্যে শুধু বাসের সংখ্যা ২৭ হাজার ৩০২টি। মিনিবাস ১০ হাজার ১৯৪টি। মাইক্রোবাস ৬৭ হাজার ৯১১টি। এসব গাড়িকে অন্তত ৩০ ধরনের পরীক্ষার পর রাস্তায় চলাচলের জন্য লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। তবে বিআরটিএর হিসাবে যা-ই থাক বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ী ও সদরঘাট রুটে চলাচলকারী ‘৮ ও ৭ নম্বর’ বাসের অধিকাংশ গাড়িতেই দেখা যায় কোনোটির গ্লাস ভাঙা, কোনোটির লুকিং গ্লাস নেই, কোনোটির সামনে ও পেছনের বাম্পার খোলা, কোনোটির জানালার কাঁচ অর্ধভাঙা হয়ে ঝুলে আছে, কোনোটির বডি দুমড়ানো-মুচড়ানো। আবার কোনো গাড়ি ভাঙাচোরা না থাকলেও রাস্তায় চলাচলের সময় ঘষাঘষির কারণে দু-তিন মাসের মধ্যেই গাড়ির রঙ উঠে গেছে। রাজধানীর মৌচাক মোড়ে যানজটে আটকে থাকা এরকম একাধিক বাস দেখা গেছে। সদরঘাট টু গাজীপুর রুটের চলাচলকারী একাধিক বাসেরও একই অবস্থা দেখা গেছে। যাত্রাবাড়ী থেকে গাজীপুর রুটে চলাচলকারী অনেক বাসেও একই অবস্থা দেখা গেছে। এমনকি ডাইরেক্ট বা বিরতিহীন লেখা অনেক বাসের ভেতরেও সিট আলগা দেখা গেছে। এছাড়া বডি ভেঙে বাঁকা হয়ে থাকা, সামনে পেছনে বাম্পার নেই এমন বাসও ভূরিভূরি। শুধু যাত্রাবাড়ী-গাজীপুর রুটেই নয়, রাজধানীর প্রায় সব রুটের বেশিরভাগ কোম্পানির বাসের অবস্থা একই রকম। ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশেষ বকশিস ব্যবস্থায় চালানো হচ্ছে এসব গাড়ি। প্রতি বছর যখন বিআরটিএ’র অভিযান জোরদার থাকে তখন কিছু সময় এসব গাড়ি ঢাকার আশপাশে পাঠানো হয়। অভিযান গতি হারানোর পর এগুলো ধীরে ধীরে রাজধানীতে প্রবেশ করে। সালমান নামের ‘৮ নম্বর’ বাসের এক চালক বলেন, মালিকপক্ষের চুক্তি আছে। অভিযানের সময় ছাড়া গাড়ি ধরলে ছেড়ে দেয়। বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ব্যবহারের অনুপযোগী যানবাহনের মালিকদের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে। এছাড়া, দুর্নীতিও বড় সমস্যা। কোনো গণপরিবহনকে রাস্তায় চলাচলের জন্য বিবেচিত হতে অন্তত ৩০ ধরনের পরীক্ষার মধ্যদিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সামান্য সংখ্যক যানই এসব পরীক্ষায় উৎরে যেতে পারে। তার পরও মালিকদের হস্তক্ষেপে গাড়িগুলোকে যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই শুধু বাইরের রঙ দেখে ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়ে দেয় বিআরটিএর কর্মকর্তারা। এদিকে বিশ্বব্যাংকের সামপ্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার গণপরিবহন খাতে ব্যাপক অসঙ্গতি ও অনিয়ম দূর করা এবং ব্যবহার অযোগ্য বাসের চলাচল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে বহুবার। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, ব্যবসায়ী, ট্রেড ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মহলের বাধায় সেসব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ঢাকার রাস্তায় চলাচলরত বেশিরভাগ বাসই ২০ বছরের পুরোনো। এসব বাসের মধ্যে অনেকগুলো কালো ধোঁয়া নির্গমন করে, ব্রেকও থাকে ত্রুটিপূর্ণ, অবৈধ হাইড্রলিক হর্ন ও যথাযথ রিয়ার ভিউ মিরর ও সিগন্যাল বাতির অভাবে এগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তার ওপর বাস, মিনিবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বেশির ভাগ যানবাহনেরই নেই বৈধ লাইসেন্স। বিআরটিএর সচিব মো. শওকত আলী মানবজমিনকে বলেন, গত ১০ বছরেও আমাদের কাছে ফিটনেসের জন্য আসেনি যেসব গাড়ি তাদের লাইসেন্স ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে। আর এমন গাড়ির সংখ্যা ৬ লাখের ওপরে। আমরা পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি তারা যেন বিআরটিএতে এসে লাইসেন্স নবায়ন করে নেয়। তাতেও কাজ হয়নি। তারপরও আমরা সুযোগ রেখেছি যে কেউ এলেই গাড়ির অবস্থা দেখে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া হবে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে লাইসেন্সই বাতিল হওয়া এসব ফিটনেসবিহীন গাড়ি ধরতে রাজধানীর সড়কগুলোতে প্রতিদিন বিআরটিএর ভ্রাম্যামাণ আদালত কাজ করছে। আদালত ফিটনেসবিহীন গাড়ি জব্দসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশেরও একাধিক টিম ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে কাজ করে। এছাড়া প্রতিটি থানা পুলিশকেও ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। এছাড়া মাঝে মাঝে বড় আকারে অভিযানও চালানো হয় ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে ২০ বছরের পুরনো যানবাহন সরিয়ে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে সরকার। তবে এ ব্যাপারে এখনও কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চলতি বছর ঘোষণা দিয়ে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযানে নামেন। অভিযান পরিচালনা করে যৌথভাবে বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। অভিযান পরিচালনায় সহায়তা করে পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। তবে শেষ পর্যন্ত আবার আগের অবস্থায় চলে যায়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলেন, আর কিছুদিন পর ঢাকা উত্তর সিটিতে পুরাতন গাড়ি থাকবে না। নতুন করে অনেকগুলো গাড়ি কেনাসহ আমরা ফ্রাঞ্চাইজি পদ্ধতি চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঢাকা সিটির মধ্যে চলাচলকারী গাড়িগুলোর এখন প্রায় ২ হাজার মালিক রয়েছে। এদের মধ্যে কারো ২টা গাড়ি, কারো ৫টা গাড়ি কেউবা আরো বেশি গাড়ির মালিক। তারা এক হতে চায় না। তারপরও এখন সবগুলো কোম্পানিকে এক করতে সক্ষম হয়েছি। সবাইকে মাত্র ৫টি কোম্পানিতে এনে ফ্রাঞ্চাইজি পদ্ধতিতে বাস চলবে। এই পদ্ধতি চালু হলে একটি গাড়ি আরেকটির আগে উঠবে না। সবাই সবার পিছে পিছে চলবে। একই রুটে আলাদা কোম্পানির কোনো গাড়ি থাকবে না। এর জন্য এখন পলিসি নির্ধারণ চলছে। আসলে গাড়ি নামানো তেমন কোনো বিষয় না। কিন্তু সেটা ব্যবস্থাপনা করাটা কঠিন। নতুন এই পদ্ধতির জন্য টার্মিনাল ও ওয়ার্কশপ তৈরি করতে হবে। নতুন করে রুট নির্ধারণ ও স্টপিজ নির্মাণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি উঠানো বা নামানোর ক্ষমতা সিটি করপোরেশনের নেই। আমরা সিটিকে সুন্দর ও যানজট মুক্ত করতে নতুন গাড়ি নামানোসহ ফ্রাঞ্চাইজি পদ্ধতি চালুর পরামর্শ দিয়েছিলাম। সেটা গ্রহণ করায় এখন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। যেহেতু একটা নতুন পদ্ধতির চিন্তা করছি তাই এই মুহূর্তে পুরনোগুলো উঠানোর মতো চিন্তা নেই। নতুনগুলো নামিয়ে পুরনোগুলো উঠানোর পরামর্শ দেয়া হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.