মোসতাফা সতেজ : 15 অক্টোবর উদযাপিত হয় গারসি উৎসব। উৎসবটি অঞ্চলভেদে পালন করতে দেখা যায়। বিশেষ করে পাবনা জেলা শহর এবং এর আশপাশের অঞ্চলে এই উৎসব বেশ ঘটা করে পালিত হতো এক সময়। সত্তরের দশকেও পাবনার কিশোর যুবকেরা ভূত-প্রেত তাড়াতে মধ্য রাতে টায়ার আর মশাল জ্বালিয়ে পাড়াময় ঘুরে বেড়াত। শহর এবং গ্রাম সবখানেই এই উৎসব পালিত হতো। এখন শহরে এই উৎসব খুব ঘটা করে পালিত না হলেও গ্রামের প্রবীণদের মধ্যে গারসি উৎসবের আমেজ লক্ষ করা যায়। এ প্রজন্মের শিশু-কিশোরেরা এ উৎসবের কথা জানে না। আগে এ দিন পাড়ায় পাড়ায় মল্ল যুদ্ধ এবং লাঠি খেলা অনুষ্ঠিত হতো। এখন আর তা হয় না।
আশ্বিনের শেষ রাতে অনুষ্ঠিত গারসি উৎসব মূলত অমঙ্গল দূর করার জন্য পালন করা হতো। অগ্রজেরা এ রাতে অনুজদের তন্ত্রমন্ত্র বা তুক-তাক শিক্ষা দিতেন। আবহমানকাল থেকে পালিত হয়ে আসা এই উৎসব উল্লেখযোগ্য ছিল। কারণ এ সময় অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকতো। ফলে শরীর সুরক্ষার জন্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এ উৎসব পালন করতেন। তারা একটি কাঁসার ঘটিতে পানি এবং আমগাছের কচি ডাল, পাতা কিছু খাদ্যসহ ঘরের চাল অথবা আঙিনায় রেখে দিতেন। পরদিন সকালে রোগ বালাই থেকে মুক্ত থাকা যাবে এই বিশ্বাসে পরিবারের সবাই এই পানি গায়ে ছিটিয়ে দিতেন। অনেকে আবার আশ্বিনের শেষ সন্ধ্যায় রান্না করে রেখে পরদিন সকালে খেতেন। এ ছাড়া তালবড়াসহ পিঠা পায়েস তৈরিরও চল ছিল।
কয়েক দশক আগেও বড় বাজারের হাজী মো. মহসিন রোডে গারসি উৎসব উপলক্ষে ক্রেতা বিক্রেতাদের ঢল নামত। আমদানি হতো নানা রকম খাদ্যদ্রব্য। যেমন বেতের ডগা , তালের বীজ, আখের ডুমা, মদনা কলা, পাকা তাল, বাতাবি লেবু, পাকা পেঁপে, নারিকেল, পেয়ারা, ঢ্যাপ, বেল, বক ফুল, খড় প্রভৃতি। এ সব কিনে বাড়ি নেয়ার পর গৃহিণীরা কুলোয় বা চালনিতে সাজিয়ে ঘরের চালে তুলে রাখত। পরদিন এ সব খাবার খাওয়া হতো দিনভর। খড়গুলো ফলজ গাছে বেঁধে রাখা হতো যাতে রোগ আক্রমণ না করে।
প্রবীণদের কাছ থেকে জানা যায়, পাবনা বাজারে গারসি উৎসব উপলক্ষে উপকরণ বিক্রি হতো। কাঁচা তেতুল, আদা, হলুদ, শুঁটকি, নতুন কুলা, বই এসব চালুন বা কুলায় সাজানো হতো। রাতে নতুন কুলা নিয়ে বাড়ির চারপাশে পরিভ্রমণ করার সময় মশা তাড়াতে কুলা পেটানো হতো। এরপর পাটখড়ির আগুনের আলোয় বই পড়ার চল ছিল। শোনা যায় এ উৎসব উপলক্ষে বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল সংগ্রহ করে খিচুড়ি রান্না করে বিতরণ করত এলাকার তরুণেরা।
ঔপন্যাসিক গিরিবালা দেবী ‘রায়বাড়ি’ উপন্যাসে উল্লেখ করেন : ‘আশ্বিন মাসের সংক্রান্তির শেষ রাতে বেড়া উপজেলার রায়বাড়িতে গারসিপূজা হয়। এটা বারোমেসে লক্ষ্মীব্রতের পর্যায়ে পড়ে। গারসি পূজো আচ্চা নয়। মেয়েলি ব্যাপার। চালুনি ডালায় গারসি পূজার উপকরণ সাজিয়ে রাখা হয়। তেল, তেলের প্রদীপ, সিঁদুর, কাঁচা হলুদ, কাঁচা তেতুল, পান, সুপারি, আদা, মাসকলাই ভিজানো, কলা, বাতাসা, পাটকাঠি প্রভৃতি। রাতে পাড়ায় পাড়ায় কুলা বাজানো হয়। পাঠকাঠির বোঝা ও হারিকেন নিয়ে উলুধ্বনি দিয়ে বচন ঝাড়া হয়। ভূত প্রেত দূরে যাক লক্ষ্মী আসুক ঘরে। পথের মাঝে গারসি পূজার দ্রব্যসম্ভার নামিয়ে রেখে পাঠকাঠিতে আগুন দেয়া হয়। বরণের ডালা হতে প্রত্যেকটি জিনিসে আগুন স্পর্শ করানো হয়। পাটকাঠির ছোট ছোট জলন্ত অংশ নিয়ে ধূমপানও করেন অনেকে। এই ধোঁয়া গলায় লাগালে সর্দি কাশি হয় না। গলার অসুখ হয় না। এমনি জাগ্রত এবং মহা মূল্যবান সেই ধোঁয়া। বাড়ির বড়রা দুএকটা টান দিয়ে ভূতের মন্ত্র আওড়াতেন-
‘ভূতের বাপের বিয়ে জলার কাঁদায় বাদ্যি বাজে, তা থই থই থিয়া। প্যাঁচায় চড়ে লক্ষ্মী আসেন ঘরে, ভূত পলায় ডরে লক্ষ্মীর হাতে ধানের বালা, মাথায় সোনার ছাতি ভূত পালালো জ্বালা তোরা হাজার সোলার বাতি।’
৩০ আশ্বিনের বিকেলে নানা রকম ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শনের ব্যবস্থাও ছিল। ‘পাবনা জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে : ‘‘জেলার মল্লযুদ্ধ ‘মালাম’ নামে খ্যাত। যাহারা ইহাতে বিশেষ অভ্যস্ত তাহারা ‘মাল’ নামে অভিহিত। ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মল্লগণ এ দিনে নানা রূপ ক্ষমতা প্রদর্শন করিয়া পুরস্কার লাভ করিয়া থাকে। এদিনে সর্বত্রই লাঠিখেলার প্রচলন আছে।’’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.