নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শামীম ওসমান ও তাঁর অনুসারীদের ভূমিকা কী হবে, সেটা নিয়ে শঙ্কায় আছে আওয়ামী লীগ। একই শঙ্কা দলীয় প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর অনুসারীদেরও।
নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণ ও প্রচার ব্যবস্থাপনায় থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা এবং আইভীর পক্ষে থাকা স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এই শঙ্কা ও দুশ্চিন্তার কথা জানা গেছে।
আইভী নিজেও ১৫ ডিসেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় শঙ্কার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে তৃতীয় পক্ষ কারসাজি করতে পারে। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক থাকতে হবে।
আইভীর ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, তৃতীয় পক্ষ বলতে নারায়ণগঞ্জের সরকারদলীয় সাংসদ শামীম ওসমান ও তাঁর অনুসারীদের বুঝিয়েছেন তিনি। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও মনে করছেন, ভোটের আগের দিন থেকে কেন্দ্রীয় নেতারা আর মাঠে থাকতে পারবেন না। তখন শামীম ওসমানের অনুসারীরাই আইভীর জন্য বাধা হয়ে উঠতে পারেন। এর মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা নিয়ে তাঁদের দুশ্চিন্তা বেশি। সিদ্ধিরগঞ্জ, সদর ও বন্দর থানা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। সেখানে মোট ভোটার ৪ লাখ ৭৯ হাজার। এর মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জে ১ লাখ ৮৫ হাজার ভোট। সিদ্ধিরগঞ্জের সাংসদ হলেন শামীম ওসমান। স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জের ২৭টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী আছেন ১৫৭ জন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৩৪ জন বিভিন্ন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও হত্যা মামলার আসামি। এর মধ্যে ১৭টি ওয়ার্ডে শামীম ওসমানের অনুসারী বা অনুগত হিসেবে পরিচিতরা কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়েছেন। তাঁদের বড় অংশ আবার সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন ওয়ার্ডের প্রার্থী। এ ধরনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীরা কেন্দ্র দখল বা জবরদস্তির ঘটনা ঘটালে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আইভী। এতে সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থী হিসেবে আইভীর ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, অন্যদিকে মেয়র পদের ব্যালট নিয়ে ভিন্ন কারসাজি করা হতে পারে। এই আশঙ্কার কথা কেন্দ্রীয় একাধিক নেতাও প্রথম আলোকে বলেছেন। আইভী নিজেও কেন্দ্র দখলের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্র দখল হতেও পারে। যেহেতু অনেক বেশি কাউন্সিলর প্রার্থী, সে ক্ষেত্রে নানা শঙ্কা থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করলে এবং কঠোর হলে শঙ্কা কেটে যাবে। সিদ্ধিরগঞ্জ প্রসঙ্গে আইভী বলেন, ‘অবশ্যই আমি চাই সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসিকে পরিবর্তন করা হোক। তা ছাড়া এখানে পুলিশ প্রশাসন যেন নিরপেক্ষভাবে কাজ করে সেই দাবি জানাব।’ ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে মেয়র পদে সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে বিপুল ভোটে হেরেছিলেন শামীম ওসমান। ওই নির্বাচনে শামীম ওসমান ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। আর আইভী নির্বাচন করেন নাগরিক সমাজের ব্যানারে। এই দুজনের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য। এবার আইভী দলের মনোনয়ন পান। শামীম ওসমানের অনুসারী স্থানীয় নেতারা শুরুতে এর বিরোধিতা করেন। পরে অবশ্য শামীম ওসমান সংবাদ সম্মেলন করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দেন। তাঁর এই ঘোষণায় আস্থা নেই আইভীর সমর্থকদের। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগও এ নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছে।
২০১১ সালের নির্বাচনে আইভীর পাশে ছিলেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি রফিউর রাব্বি। এরপর রাব্বির কলেজপড়ুয়া মেধাবী ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী খুন হন। অভিযোগ ওঠে শামীম ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে। নারায়ণগঞ্জে গঠন করা হয় সন্ত্রাসবিরোধী ত্বকী মঞ্চ। এই মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি এবারও আইভীর সঙ্গে আছেন।
আইভী যে তৃতীয় পক্ষ নিয়ে শঙ্কিত, তারা কারা—এ বিষয়ে জানতে চাইলে রফিউর রাব্বি প্রথম আলোকে বলেন, গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যারা আইভীর কাছে পরাজিত হয়েছিল, পরে খুনখারাবির উৎসবে মেতেছিল, তাদেরই তৃতীয় পক্ষ বুঝিয়েছেন আইভী।
জানতে চাইলে শামীম ওসমান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইভী তো আমার ব্যাপারে ইঙ্গিত করেনি। আইভী কেন আমার ব্যাপারে ইঙ্গিত করবে? আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে কাজে নেমেছি। ও (আইভী) আমাকে হাইলি রেসপেক্ট দেখিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আপনারা এ জিনিস খুঁজতে যান কেন? সে তো আমার দলের প্রার্থী, নৌকার প্রার্থী। তৃতীয় পক্ষ বলতে বিএনপিকেই বুঝিয়েছে। বিএনপি আছে, জামায়াত আছে।’
শামীম ওসমান আরও বলেন, ‘আমাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোনো কোন্দল নাই। শি ইজ মাই ইয়ংগার সিস্টার। আমরা ভাইবোনে কী ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে, সেটা আমাদের ব্যাপার। বাট, যখন প্রতীক নৌকা, সেখানে কোনো এক্সকিউজ নাই। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশনের মাধ্যমে নৌকাকে জয়লাভ করাতে এবং আমরা সেটা করছি।’
তৃতীয় পক্ষ বলতে কাকে বোঝাচ্ছেন—এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেলিনা হায়াৎ আইভী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৃতীয় পক্ষ বলতে আমি আসলে কী মিন করতে চাইছি, সেটা আমি না-ই বললাম। আপনারা খুঁজে নেন তৃতীয় পক্ষটা কে?’ তিনি বলেন, ‘আমার কোনো বাহিনী নেই। কিন্তু সাখাওয়াত সাহেব (বিএনপির প্রার্থী) প্রতিদিন অভিযোগ করে বেড়াচ্ছেন, লোকজন হুমকি দিচ্ছে। তাঁর লোকজনকে মারধর করছে। এগুলো কারা করছে আমি ঠিক জানি না। হয় সাখাওয়াত সাহেব অসত্য বলছেন, না হয় অন্য কেউ এসব করছে।’
আইভী আরও বলেন, এটা ঠিক, নারায়ণগঞ্জ শহরে একটা রব আছে যে যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। অনেকে আশঙ্কা করছে, কিছু একটা হতে পারে।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন তদারকির দায়িত্বে থাকা দুজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব জরিপেও আইভীর এগিয়ে থাকার তথ্য এসেছে। নির্বাচনে কোনো রকম জোরজবরদস্তির বিপক্ষে আইভী। সরকারের ওপরমহল থেকেও নিরপেক্ষভাবে ভোট গ্রহণ নিশ্চিত করতে বার্তা দেওয়া হবে। এ অবস্থায় দলের কারও ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ মনে হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ওই দুই নেতা আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জে মেয়র পদ নিয়েই তাঁদের মূল ভাবনা। অধিক সংখ্যায় কাউন্সিলর জয়ী করার চেষ্টা দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নেই। কারণ, মেয়র পদ নিয়ে সারা দেশেই আগ্রহ আছে। নতুন একটা নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রাক্কালে এই ভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলে এবং প্রতীকের কারণে এর একটা জাতীয় আবহ আছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূতেরাও নির্বাচনের অবস্থা সম্পর্কে অনানুষ্ঠানিক জানতে চাইছেন। এ জন্য দলীয় প্রার্থীর জয় আকাঙ্ক্ষিত। আবার নির্বাচনে বদনাম হোক, সেটাও সরকার চায় না।
আইভীর প্রচারের জন্য প্রায় প্রতিদিনই নারায়ণগঞ্জে যাচ্ছেন এমন একজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমান ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে এই নির্বাচন নিয়ে হঠাৎ আগ্রহ বেড়ে গেছে। তাঁদের আগ্রহ বেশি কাউন্সিলর পদ নিয়ে। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্র থেকে কাউন্সিলর নিয়ে বেশি মাথা না ঘামানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, শামীম ওসমানের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কায় দলের অনেক সাধারণ কর্মী আইভীর পক্ষে নামছেন না। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওনার (আইভী) লাইনে উনি কাজ করতেছেন, আমাদের লাইনে আমরা কাজ করতেছি। আইভী যদি চান, মহানগরের কোনো নেতার তাঁর সঙ্গে কোথাও প্রচারে যাওয়া দরকার, তাহলে যাবে।’
কেন্দ্রীয় দুজন নেতা বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগে শামীম ওসমান অনুসারীদের সঙ্গে আইভী-সমর্থকদের অবিশ্বাসের সম্পর্ক বিদ্যমান। আইভী নিজেও বদনাম রয়েছে এমন নেতাদের এড়িয়ে চলছেন। এ পরিস্থিতিতে শামীম ওসমান নিষ্ক্রিয় থাকলেই আইভীর জন্য ভালো বলে অনেকে মনে করেন।
শামীম ওসমানের কারণে নির্বাচনে আইভীর অবস্থান খারাপ হতে পারে—এ আশঙ্কার বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের সমন্বয়ক কাজী জাফর উল্যাহ গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা আমরাও শুনতেছি। ১৫ দিন আগে এ আলোচনা আরও ব্যাপক ছিল। এখন কেন্দ্রীয়ভাবে আমরা ১৫-২০ জন কাজ করছি। মনে সেটা কমে এসেছে।’ তিনি বলেন, গতকাল সন্ধ্যায় তিনি নারায়ণগঞ্জে গিয়ে ২৭টি ওয়ার্ডের দলের ২৭ জন সমন্বয়ককে নিয়ে বৈঠক করেছেন। ভোটের আগে সব ভুল-বোঝাবুঝি দূর করতে পারলে আইভীর বিজয় নিশ্চিত।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.