রিজার্ভ চুরি
বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার রিজার্ভ চুরির ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের প্রায় সবাইকে চিহ্নিত করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঁচ বিভাগের ১৪ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। তারা সবাই ব্যাংকের কম্পিউটার সুইফট সিস্টেম হ্যাকিংয়ের প্লট তৈরিতে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছেন। সংশ্লিষ্ট ১০৮ জনকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদসহ প্রয়োজনীয় তদন্ত শেষে সিআইডির কর্মকর্তারা নিশ্চিত হয়েছেন উল্লিখিত বিষয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ১৪ জন জড়িত আছেন, তাদের মধ্যে অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের চারজন, পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের চারজন, আইটি অপারেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের চারজন, ফরেন রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দুইজন এবং ব্যাংক অফিস অব দ্য ডিলিংস রুমের একজন কর্মকর্তা রয়েছেন।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিএম পদের কয়েকজন কর্মকর্তা, যে প্রকল্পের মাধ্যমে সুইফট হ্যাক করা হয় ওই প্রকল্পের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা এবং সাবেক গভর্নরের সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তৎকালীন গভর্নর রিজার্ভ চুরির ঘটনা কেন ৪০ দিন গোপন রেখেছিলেন, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ও প্রধান তদন্ত তদারক কর্মকর্তা মো. শাহ আলম যুগান্তরকে বলেন, রিজার্ভ চুরির আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সিস্টেম সুরক্ষিত ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কিছু বিদেশী মিলে এমনভাবে কাজ করেছেন, যার ফলে পুরো সার্ভার অরক্ষিত হয়ে পড়ে।
তিনি জানান, চলতি বছর ৩১ জানুয়ারি হ্যাকারদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সুইফট সিস্টেম। বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা সুইফট সিস্টেম দুর্বল করতে সর্বাÍক সহায়তা করেছে, হ্যাকিংকে ত্বরান্বিত করেছে, সর্বোপরি অপরাধে জড়িয়েছে, তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য এখন সিআইডির হাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
মো. শাহ আলম আরও বলেন, এরই মধ্যে ২৩ বিদেশীকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা আমাদের টাকাগুলো বের করে নিয়ে গেছে। তবে ওই ২৩ বিদেশী ছিল অপারেটর। তাদের মাধ্যমে টাকাগুলো মূল পরিকল্পনাকারীদের হাতে চলে যায়। তিনি বলেন, ভুয়া হিসাবধারী বিদেশী ওই চক্রের অন্তত ২৫ জনকে শনাক্ত করতে কাজ চলছে।
এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘আরটিজিএস’ প্রকল্পের মাধ্যমে সুইফট হ্যাক করা হয়। ওই প্রকল্পটা না আনা হলে এখানে হ্যাকিংয়ের মতো ঘটনা ঘটত না। জানা গেছে, এ বিষয়ে এরই মধ্যে ওই প্রকল্পের পরিচালকসহ ব্যাংকের শতাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় অপরাধ তদন্ত সংস্থা সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের কথা ছিল রোববার। কিন্তু সিআইডির তদন্ত শেষ না হওয়ায় আগামী ১৭ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য করেছেন ঢাকার সিএমএম আদালত।
এ সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ হবে কিনা জানতে চাইলে কর্মকর্তারা জানান, রিজার্ভ চুরিতে সহায়তাকারী বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেকের বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলেও এর সঙ্গে জড়িত বাইরের হ্যাকারদের বিষয়ে অনুসন্ধান শেষ করতে সময় লাগবে।
প্রসঙ্গত, রিজার্ভ চুরি ঘটনার ৪০ দিন পর গত ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের উপপরিচালক জোবায়ের বিন হুদা বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মতিঝিল থানায় মামলা দায়ের করেন।
মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ (সংশোধনী আইন-২০১৫) এর ৪ ধারা এবং ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৪ ধারা ও দণ্ডবিধির ৩৭৯ ধারায় দায়ের হওয়া ওই মামলার তদন্ত করছে সিআইডি।
সূত্র জানায়, তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের যাদের অপরাধের প্রমাণ মিলেছে সিআইডির ভাষায় এরা ‘কালপ্রিট’। হ্যাকিংয়ের পুরো নীল নকশা চূড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়ন করেছে এ চক্রটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের ৮ জনের কাছে সুইফটের ইউজার আইডি ছিল। এদের মধ্য থেকে একজনের আইডি হ্যাক করে রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটানো হয়।
সূত্র জানায়, কিছু অচেনা লোক হ্যাকিংয়ের ঘটনার আগে ও পরে বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢোকার সময় নিজেদের নাম-ঠিকানা রেজিস্টার খাতায় লিপিবদ্ধও করেনি। সিআইডি সূত্র বলছে, চুরির আগে অপরিচিত রহস্যজনক অনেক লোক বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকেছে, তাদের নাম খাতায় এন্ট্রি নেই কেন- এ বিষয়ে সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এছাড়া হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরির ঘটনা জানার পরও সেই তথ্য ৪০ দিন কেন গোপন করে রাখা হল, সে বিষয়েও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে সিআইডির গত ৮ মাসের তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরের চক্রটিকে শনাক্ত করা সম্ভব হলেও মূল পরিকল্পনাকারীদের অনেকেই এখনও রয়েছে আড়ালে। যাদের নিখুঁত পরিকল্পনায় কয়েকটি ধাপে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকারদের মাধ্যমে সরানো হয়।
এছাড়া বিদেশী যে চক্রটি এ কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের মধ্যে ২৫ জনের বিষয়ে অনেক তথ্য এখনও বের করতে পারেনি সিআইডি। যারা নিজের নাম-ঠিকানা গোপন করে অন্যের ছবি ব্যবহার করে হ্যাকিংয়ের অর্থ ওইসব হিসাবের মাধ্যমে স্থানান্তর করেছে।
এদিকে রিজার্ভ চুরিতে জড়িত ফিলিপাইনের ১৬ জন ও শ্রীলংকার ৭ জনের বিরুদ্ধে যদি ওইসব দেশের মানিলন্ডারিং এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলাও হয়, তারপরও বাংলাদেশের আইনে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট হবে বলে জানা গেছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.