তবে এবার বদলাবে সেই চিত্র। কারণ প্রথমবারের মতো দেশেই তৈরি হচ্ছে দ্বিতীয় প্রজন্মের সৌর প্যানেল (থিন ফিল্ম সোলার সেল)। এরই মধ্যে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এই সেল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এখন চলছে তার মানোন্নয়নের কাজ। আগামী দু’বছরের মধ্যে এটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের উপযোগী হয়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের খরচ কমবে অন্তত ৪০ শতাংশ। পাশাপাশি ব্যাটারিবিহীন প্রযুক্তিতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করলে সোলার সিস্টেম স্থাপনের খরচ অর্ধেকে নেমে আসবে।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) জ্বালানি গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই সৌরশক্তি নিয়ে গবেষণা করছেন। গবেষক দলের প্রধান ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুহাম্মদ শাহরিয়ার বাসার সমকালকে বলেন, ২০১২ সালে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। কয়েক মাস আগে তৈরি করা সম্ভব হয় কাঙ্ক্ষিত ‘থিন ফিল্ম সোলার সেল’। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে এখনও প্রথম প্রজন্মের অর্থাৎ ক্রিস্টালাইন সিলিকন সেলই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে। তবে সেটির চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা দেবে নতুন এই সেল। সরাসরি সূর্যের আলো না পেলেও, এমনকি মেঘলা দিনেও এটি বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। তিনি জানান, এ ধরনের সেল তৈরির উপাদান সহজলভ্য হওয়ায় খরচ কম পড়ে। অদূর ভবিষ্যতে এটি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। তিনি জানান, এ কারণে বাংলাদেশে এই সেল উৎপাদন করা গেলে অনেক কম খরচে তা মানুষের কাছে পেঁৗছে দেওয়া যাবে। সৌরশক্তি বিষয়ে গবেষণার সুযোগ থাকায় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও দেশে সোলার প্যানেল তৈরির কারখানা স্থাপনে আগ্রহী হবে। তবে বিসিএসআইআরের গবেষণাগারে তৈরি আধুনিক সোলার প্যানেলের সক্ষমতা এখনও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পেঁৗছেনি। সেটির মানোন্নয়নের জন্যই গবেষক দল কাজ করছে।
জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী মুহাম্মদ শাহরিয়ার বাসার জানান, সৌর প্যানেল স্থাপনের ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ব্যাটারি। ধরা যাক, দুটি বাল্ব ও একটি বৈদ্যুতিক পাখা চালানোর জন্য সোলার সিস্টেম স্থাপনে খরচ হবে ২০ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে প্যানেলের জন্য সাড়ে তিন হাজার ও চার্জ কন্ট্রোলারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। অথচ শুধু ব্যাটারির জন্যই লাগবে ১২ হাজার টাকা। সেই ব্যাটারির আয়ুও মাত্র দুই বছর। যেখানে প্যানেলের মেয়াদ ২৫ বছর ও চার্জ কন্ট্রোলারের মেয়াদ পাঁচ থেকে সাত বছর। তাই ব্যাটারি ছাড়াই সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের একটি পন্থা আবিষ্কার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দিনের আলোয় প্যানেলে উৎপন্ন সৌরবিদ্যুৎ পাওয়ার গ্রিডে যুক্ত হবে। সাধারণ বিদ্যুৎ সংযোগ ও সৌর প্যানেল থেকে আসা বিদ্যুতের সমন্বয়ের জন্য একটি যন্ত্র থাকবে। যখন সৌর প্যানেল থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, তখন সেটা ব্যবহার হবে। আর সেটি থেকে না পাওয়া গেলে সাধারণ সংযোগ থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ ব্যবহার হবে। এর ফলে ব্যাটারি ছাড়াই প্রায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা পাওয়া সম্ভব হবে। বিসিএসআইআর ঢাকা কার্যালয়ে এমন ৬৪ ও জয়পুরহাটে ৫৫ কিলোওয়াট-পিক ক্ষমতাসম্পন্ন প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। অবশ্য ব্যাটারি না থাকায় বিদ্যুৎ সঞ্চয়ের কোনো ব্যবস্থা থাকছে না। তাই দিনের আলোর অনুপস্থিতি ও সাধারণ সংযোগে লোডশেডিংয়ের সময় এ সেবা পাওয়া যাবে না।
বিসিএসআইআর সূত্র জানায়, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৪০ লাখ ‘সোলার হোম সিস্টেম’ রয়েছে। মূলত চীন ও ভারত থেকে এসব সৌর প্যানেল আমদানি করা হয়। তবে সেগুলোর মান পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা এতদিন দেশে ছিল না। এজন্য গত বছর ‘সোলার এনার্জি টেকনোলজি রিসার্চ ল্যাবরেটরি’ স্থাপন করা হয়েছে। এখানে প্যানেলসহ সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থার সব সরঞ্জামের মান পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) সব ধরনের সৌর সরঞ্জাম পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করেছে। এর ফলে আমদানি করা সব সরঞ্জামের মান নিশ্চিত করা যাবে। গ্রাহকরা পাবেন উন্নত সেবা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রথম প্রজন্মের সৌর প্যানেলে ব্যবহৃত ক্রিস্টালাইন সিলিকন সোলার সেল নিয়ে কয়েক বছর ধরে গবেষণা করে আসছে আণবিক শক্তি কমিশনের অধীন ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রনিক্স। তারা নিজেদের তৈরি ও আমদানি করা যন্ত্রাংশ বা উপাদান মিলিয়ে প্যানেল তৈরি করছে। দেশের বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও বিদেশ থেকে সরঞ্জাম এনে সংযোজনের কাজ করে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.