অবশেষে রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ায় বন্ধ থাকা পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ। সংস্থাটির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান রোববার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, সোমবার থেকে পোশাক কারখানাগুলো খুলবে। মজুরি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনের একপর্যায়ে বিজিএমইএ আশুলিয়ার ৫৯টি পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছিল। প্রশ্ন হলো দুই সপ্তাহ ধরে কারখানাগুলো বন্ধ রাখার প্রয়োজন ছিল কি না? যেকোনো সমস্যা সমাধানের উত্তম উপায় হলো আলোচনা। সেটি জাতীয় রাজনীতি হোক আর মজুরি নিয়ে কারখানা মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্ব হোক। কিন্তু আমাদের দেশে ক্ষমতাধরেরা এটি সাধারণত বুঝতে চান না; বুঝলেও অনেক পরে বোঝেন। একদিন কারখানা বন্ধ রাখলে যে ক্ষতি, শ্রমিকদের দাবি মেনে নিলে তার চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম। তারপরও আশুলিয়ায় ৫৯টি তৈরি পোশাক কারখানা দুই সপ্তাহ ধরে মালিকেরা বন্ধ রেখেছেন শ্রমিক অসন্তোষের অজুহাত তুলে। দু-একটি কারখানায় যে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল, আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু মালিকপক্ষ সেদিকে না গিয়ে সাফ জানিয়ে দিল, কোনো অবস্থায় তারা শ্রমিকদের মজুরি বাড়াবে না। ফলে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ল এবং এ অজুহাতে কারখানার দরজা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। মালিকেরা শ্রমিকদের শাস্তি দিতে গিয়ে নিজেদেরও ক্ষতি করলেন। এই শাস্তি ও ক্ষতি কোনোটাই সামান্য নয়। কারখানা বন্ধ হওয়ায় অনেক শ্রমিক বাড়ি চলে গেছেন। কেননা, তাঁদের আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যত দিন কারখানা বন্ধ থাকবে, তত দিন শ্রমিকেরা মজুরি পাবেন না।
শ্রমিকেরা বেতন না পেলে বাসাভাড়া দিয়ে থাকবেন কীভাবে? মালিকেরা নানাভাবে ক্ষতি পুষিয়ে নেবেন। প্রয়োজনে সরকারের সহায়তা পাবেন, ক্রেতাদের কাছেও শ্রমিক অসন্তোষের কথা বলে পণ্যের দাম বাড়িয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু গরিব শ্রমিকদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার কোনো উপায় নেই। আশুলিয়ায় শ্রমিক অসন্তোষের শুরুতে মালিকপক্ষ ও সরকার ইতিবাচক মনোভাব দেখালে আগেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসত এবং শ্রমিকেরাও কাজে ফিরে আসতেন। বিজিএমইএর সিদ্ধান্তের আগেই সেখানে কয়েকটি কারখানা খুলেও দেওয়া হয়। শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবি মোটেই অযৌক্তিক নয়। শ্রমিকেরা ১৬ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবি জানিয়েছেন। মালিকেরা বলছেন, এটি যুক্তিসংগত নয়। তিন বছর আগে মজুরি বাড়ানো হয়েছে। তিন বছরে কি জীবনযাত্রার কোনো ব্যয় বাড়েনি? বেড়েছে। তাই মজুরি যৌক্তিক হারেই বাড়াতে হবে। মজুরি নির্ধারণের সময় বলা হয়েছিল, শ্রমিকদের বাসাভাড়া বাড়ানো হবে না। কিন্তু বাসাভাড়া বেড়েছে। আর বিষয়টি সরকার বা মালিকদের হাতেও নয়। গত বছর ঘোষিত সরকারি বেতন রোয়েদাদে সরকারি কর্মচারী এবং সরকারি খাতের শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ অবস্থায় বেসরকারি খাতের শ্রমিকদের মজুরি না বাড়ানো অন্যায় ও অযৌক্তিক। পত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবিতে তাঁরা কর্মবিরতি শুরু করায় অশান্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তবে শনিবার সকাল থেকে আশুলিয়ার ইউনিক, জামগড়া, নরসিংহপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের দুই পাশের কারখানাগুলোর সামনে ও মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকদের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। এসব শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা কাজে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক কাজী রুহুল আমিন জানিয়েছেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বাড়িভাড়া বেড়েছে, কিন্তু মজুরি বাড়েনি। শ্রমিকেরাও তো তাঁদের রুটি-রুজির জায়গা স্বাভাবিক দেখতে চান। তবে তাঁদেরও তো বেঁচে থাকার ন্যূনতম মজুরি দরকার। বিজিএমইএ বরাবর চিঠি দিয়েছে অন্তত পাঁচটি শ্রমিক সংগঠন। গত বৃহস্পতিবার দেওয়া ওই চিঠির অনুলিপি শ্রম প্রতিমন্ত্রী, শ্রমসচিব, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শ্রম পরিচালকের কাছেও দেওয়া হয়েছে। এর আগে বিজিএমইএ সভাপতি বলেছিলেন, সরকার বললে আশুলিয়ায় বন্ধ থাকা সব কারখানা খুলে দেওয়া হবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কারখানায় নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। মালিকপক্ষকে মনে রাখতে হবে, কারখানার প্রধান নিরাপত্তা ও শক্তি শ্রমিক। তাঁদের বঞ্চিত করে শিল্পের উন্নয়ন করা যাবে না। আমরা আশা করব, শ্রমিকেরা কাজে ফিরে আসবেন। মালিকপক্ষ আলোচনায় বসবে। তারা নিঃশর্ত আলোচনার কথা বলেছে। আমরা তাদের এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই। একই সঙ্গে একটি শর্ত তাদের মানতেই হবে এবং সেটি হলো সাম্প্রতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনো শ্রমিককে হয়রানি বা চাকরিচ্যুত করা যাবে না; কারখানা বন্ধ থাকার সময়ে তাঁদের মজুরি কাটা যাবে না। কেননা তাঁরা কারখানা বন্ধ করেননি, বন্ধ করেছে মালিকপক্ষ।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.