মেঘের রাজ্য গেন্টিং আইল্যান্ড
বাসটা ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করল। মনে হচ্ছিল যেন বিমান আকাশে উড়তে চলেছে। পথের দুপাশে সবুজ পাহাড়। পাহাড়কে বেড় দিয়ে উঠেছে গেন্টিং হাইল্যান্ড-এর পথ। তিন বন্ধু মিলে গোম্বাক থেকে গেন্টিং যাচ্ছি – ছয় হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর মালয়েশিয়ার গেন্টিং হাইল্যান্ড শহরকে মালয়েশিয়ার সব চেয়ে উঁচু জায়গা বলা যায়। কুয়ালালামপুর থেকে বেশ কাছেই। বাসে ভাড়া পড়ল মাথাপিছু ৯.৪০ রিঙ্গিত। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর গেন্টিং স্কাইওয়ের সামনে বাস থেকে নামলাম। কেবল্ কারে চড়তে হলে গেন্টিং স্কাইওয়ের সামনেই নামতে হবে। কেবল্ কারের টিকিট গোম্বাক থেকে বাসের টিকিট কেনার সময়েই একসঙ্গে হয়ে গিয়েছিল। একই টিকিট দিয়ে বাস ও কেবল্ কারে ওঠা যায়। কেবল্ কারে না উঠতে চাইলে অবশ্য সরাসরিও বাসে করে গেন্টিং হাইল্যান্ডে পৌঁছে যাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে পুডু টার্মিনাল থেকে বাসে উঠতে হবে। কেবল্ কারে উঠার সময় দেখতে পেলাম অসংখ্য পর্যটকের ভিড়। রবিবার ছুটির দিন বলেই ভিড় আজ আরও বেশি। লাইন ধরে একটু একটু করে সামনের দিকে আগালাম। তারপর উঠে বসলাম কেবল্ কারের ভিতরে। কেবল্ কারে চড়ে আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। নীচে মেঘে ঢাকা সবুজ পাহাড়, হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো, ঝকঝকে রাস্তাঘাট ভারি সুন্দর লাগছিল। গেন্টিং হাইল্যান্ড এর আগেও একবার গিয়েছি কিন্তূ তখন যাওয়ার সময় কেবল্ কারে চড়া হয়নি। ফিরে আসার সময় কেবল্ কারে করে নিচে নেমেছিলাম। অবশেষে পৌঁছালাম গেন্টিং হাইল্যান্ডের একেবারে মাথায়,ছয় হাজার ফুট উঁচুতে। শহরে পৌঁছানোর সাথে সাথেই প্রচণ্ড শীত অনুভব করলাম। হাতে থাকা শীতের কাপড়টি গায়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পর পর মেঘ এসে ঘিরে ফেলছে আমাদের, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। প্রচণ্ড বাতাস যেন ঘুড়ির মতো উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছিল। মেঘে ঢাকা পড়ে বড় বড় বিল্ডিংগুলো। চারিদিকের সবুজ পাহাড়গুলো আমাদের থেকে নীচে। পাহাড়ের এক পাশে ঘন কালো মেঘের অন্ধকার। দূরে দেখা যায় রোদের রেখা। রোদের মাঝেই হঠাৎ বৃষ্টি। এ যেন এক মেঘের রাজ্য। মনে হচ্ছে যেন আকাশের উপর বসে থেকে আমরা দেশটাকে দেখছি। দুপুরের খাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম গেন্টিং দর্শনে। মালয়েশিয়ার অন্যান্য জায়গার চেয়ে গেন্টিং হাইল্যান্ডে খাবারের দাম অনেক বেশি। সাইন বোর্ডের দিক নির্দেশনা দেখে প্রথমে পৌঁছে গেলাম গেন্টিং থিমপার্কে। এখানে রোলার কোস্টার সহ নানা ধরনের রাইড রয়েছে। অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন রাইডে চড়লাম। থিম পার্কে ঢোকার জন্য জনপ্রতি ৫০ রিঙ্গিত মূল্যের টিকিট লাগে। এই টিকিটেই সব রাইডে ওঠা যায়। তবে গেন্টিং হাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ক্যাসিনো। এই শহরটি জুয়াড়িদের কাছে খুবই পরিচিত। বিশ্বের অনেক দেশ থেকে জুয়াড়িরা এখানে জুয়া খেলতে আসেন। গেন্টিং হাইল্যান্ড গেলে দেখা যায় বিশ্বের সব দামী দামী গাড়ি, মালয়েশিয়ার অন্য কোথাও কিন্তু এই গাড়িগুলো সব সময় দেখা যায় না। ক্যাসিনো ক্লাবে সবাই প্রবেশ করতে পারে এবং জুয়া খেলতে পারে। তবে অবশ্যই বৈধ পাসপোর্ট থাকতে হবে। ক্লাবের ভিতরে ছবি তোলা যায় না। ভিতরে প্রবেশ করার সময়েই সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে কাউন্টারে জমা রেখে যেতে হয়। ক্লাবে প্রবেশের জন্য অবশ্য কোনো খরচ গুনতে হয়না। আমরা কেউ ক্যাসিনো খেলতে পারি না। ক্যাসিনো ক্লাবের ভিতরে গিয়ে কিছুক্ষণ অন্যদের খেলা দেখছিলাম। কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। ক্যাসিনোতে প্রতিদিন রিঙ্গিতের বিকল্প প্লাস্টিক কাউন্টার দিয়ে কোটি কোটি রিঙ্গিতের জুয়া খেলা হয়। জেতার পর ক্যাশিয়ারের কাছে কাউন্টার নিয়ে গেলেই ওইগুলোর বিনিময়ে সমমূল্যের রিঙ্গিত পাওয়া যায়। এখানে আরেক মজাদার আকর্ষণ ভূতের আড্ডা। মানুষ ভূত সেজে ভয় দেখাচ্ছে।এছাড়া পর্যটক আকর্ষণের জন্য সারাবছরই চলছে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে সন্ধ্যায় আবার কেবল্ কারে চড়ে বাস টার্মিনালের সামনে আসলাম। ফিরে আসার সময় বাসে বসে দূর থেকে দেখতে পেলাম আলোক সজ্জায় সজ্জিত গেন্টিং হাইল্যান্ড। দিনের বেলার মেঘে ঢাকা চেনা শহরটাকে রাতের আঁধারে যেন মনে হচ্ছে আলোয় মোড়া অচেনা এক দেশ।
নীল-সবুজের লাংকাউই
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা লাংকাউই দ্বীপ ও সেখানকার সমুদ্র সৈকত যেন কোনো এক শিল্পীর তুলিতে আঁকা সুনিপুণ চিত্রকর্ম। যতবার এর সান্নিধ্যে এসেছি ততবারই মুগ্ধ হয়েছি আর প্রশংসা করেছি সেই স্রষ্টার যিনি এত যত্ন নিয়ে সৃষ্টি করেছেন।তিনদিনের হঠাৎ এক ছুটিতে আমরা পাঁচবন্ধু – মিলন,বাদশা,তুহিন, ওয়াসিম আর আমি আবারও বেরিয়ে পড়েছিলাম সেই অপরূপ প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যের আশায়। রাত ১২ টায় পুডু বাস টার্মিনাল থেকে আমাদের দোতলা বাসটি যাত্রা শুরু করল কুয়ালা পারলিস ফেরি ঘাটের উদ্দেশে।ভাড়া মাথাপিছু ৪৭ রিঙ্গিত। ইউরো ২০১২ ফুটবল ম্যাচের খেলা উপভোগ করছিলাম টিভির পর্দায়। মধ্যরাতের নীরবতাকে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল আমাদের বাসটি। নিজের অজান্তেই মন হারিয়ে যাচ্ছিল ফেলে আসা কোনো হৃদয়-নিংড়ানো স্মৃতি রোমন্থনে। প্রায় তিন ঘন্টা পর বাসটি দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে আরও অনেক পথ বাকি। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক – কেমন মায়াবী হয়ে উঠেছে। চুপ করে বসে আপনমনে তাই যেন অনুভব করছিলাম। কুড়ি মিনিটের বিরতির পর আবার বাস চলতে শুরু করল। বাস চলেছে তার আপন গতিতে। গভীর রাত, ক্লান্ত শরীর আর এসির শীতল হাওয়া। এবার কিন্তু সত্যি সত্যিই ঘুম পাচ্ছে। কিন্তূ ঘুমালাম না। কোথাও ভ্রমণে যাওয়ার সময় আমার ঘুম হয়না। বাসের ভেতরটা এখন নীরব। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে চারদিকটা আলোকিত হয়ে উঠছে। উঁচু-নিচু পাহাড় আর সবুজে ঘেরা বনভূমির মধ্য দিয়ে আঁকাবাকা পথ। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় সুন্দর প্রকৃতি যেন আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য অসম্ভব রকমের শিহরণ জাগায় মনে। অবশেষে প্রায় নয় ঘন্টা পর আমরা কুয়ালা পারলিস ফেরি ঘাটে পৌঁছলাম। লাংকাউই দ্বীপে যেতে এখান থেকেই লঞ্চে উঠতে হবে। জন প্রতি ১৮ রিঙ্গিত দিয়ে লঞ্চের টিকিট কিনে নিলাম। লঞ্চ ছাড়তে আরও বিশ মিনিট বাকি। এরমধ্যে নাস্তা খেয়ে নিলাম। লঞ্চে উঠে সিট নাম্বার মিলিয়ে দেখি আমাদের সবার সিট এক সঙ্গে পাইনি। আমাদের তিনজনের পাশে অন্য যে দুইজন বসেছেন তাঁদের অনুরোধ করলাম আমাদের এক সাথে বসতে দেওয়ার জন্য। ওঁরা রাজি হলে আমরা পাঁচ জন এক সঙ্গে বসলাম। ছাড়ার পর কিছুটা গিয়ে হঠাৎ লঞ্চের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে বুঝতে পারলাম। সমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে লঞ্চটি। ঢেউয়ের সাথে সাথে দুলছে। খুব ভয় পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল এই বুঝি দুর্ঘটনা ঘটে গেলো। বার বার বাহির হওয়ার দরজাগুলো গুনছি আর লাইফ জ্যাকেটের দিকে তাকাচ্ছি। কিন্তূ না, একটু পরে লঞ্চ আবার চলতে শুরু করল, আমরাও নিশ্চিন্ত হলাম। ইঞ্জিনে সামান্য সমস্যা দেখা দেওয়ার কারণে এমন হয়েছে। মোবাইলে একটি মেসেজ পেলাম। আমরা থাইল্যান্ড এর সীমান্তের কাছে রয়েছি। মেসেজটি ছিল যদি থাইল্যান্ড এর নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে চাই তাহলে কী করতে হবে। এক ঘন্টা বিশ মিনিট পর লাংকাউই দ্বীপে গিয়ে পৌছলাম। এমনিতে পৌঁছাতে মিনিট পঞ্চাশ সময় লাগে। ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দেওয়ায় প্রায় আধঘন্টা বেশি লেগেছে। লাংকাউইতে ঘোরার জন্য যে কোনো রকমের গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। আপনি যে কয়দিনের জন্য গাড়ি ভাড়া নিবেন ততদিন গাড়ি আপনার তত্ত্বাবধানে থাকবে। কিন্তূ অবশ্যই আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকতে হবে এবং গাড়ি আপনাকে নিজেই চালাতে হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্স যে কোনো দেশের হলেই চলবে। দিন প্রতি ৩০ রিঙ্গিত দিয়ে এক-একটি মোটর সাইকেল ভাড়া নিলাম। গাড়ি ভাড়া করে ঘুরলে নিজের ইচ্ছা মতো ঘোরা যায় এবং মালয়েশিয়ায় তেলের দাম কম (পেট্রল ১.৯০ রিঙ্গিত লিটার) বলে খরচও কম হয়। মোটর সাইকেল নিয়ে রওনা হলাম পান্তাই চেনাং বিচের উদ্দেশে। কার আগে কে যাবে প্রতিযোগিতা শুরু হলো। সবাই আগেও এসেছি তাই চেনা পথ। পান্তাই চেনাং পৌঁছানোর পর হোটেলে রুম ভাড়া করলাম দিন প্রতি ৮০ রিঙ্গিত দিয়ে। রুমে সব কিছু রেখে আর দেরি করলাম না। বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্র স্নানের উদ্দেশে। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ সৈকতে পর্যটক বেশ কম। দূরে একটি লাল পতাকা দেখতে পেলাম। এবার বুঝলাম পর্যটক কম কেন। বিপদ সংকেত চলছে তাই। যখন পাঁচমূর্তি একসাথে তখন কোনকিছুই কি আর বাধা হতে পারে? ঝাঁপিয়ে পড়লাম সমুদ্রের বুকে। তবে সবাইকে বলেছিলাম সতর্ক থাকতে, খুব বেশি দুরে যেন কেউ না যায়। সমুদ্রের সান্নিধ্যে এসে বাঁধভাঙা আনন্দে মুহূর্তের মধ্যে সবাই যেন বদলে গেলাম। বড় বড় ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরাও যেন সমান তালে উচ্ছ্বসিত হয়ে আছড়ে পড়ছি বারবার। লবণাক্ত পানি মুখে যাচ্ছে, তাতে কী যায় আসে, প্রাণের উচ্ছ্বাস বলে কথা! ঘন্টা দুয়েক পরে অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সমুদ্র থেকে উঠে আসতে হলো। লাঞ্চের পর রুমে আসলাম একটু বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে। ক্লান্ত শরীরে বিছানায় শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে পরেছিলাম সবাই। জেগে উঠে দেখি সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। সমুদ্র সৈকতে বালিতে খানিক খালি পায়ে হাঁটলাম। তারপর একেবারে রাতের খাবার খেয়ে লাংকাউই বিমান বন্দরের পাশে গিয়ে বসলাম। একটির পর একটি বিমান নামছে রানওয়েতে। চুপ করে বসে এই দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। হোটেলে ফিরে এসে সবাই মিলে আড্ডায় বসলাম। কার্ড খেলতে খেলতেই ভোর হয়ে গেল। সকালে ঠিক হলো আজ সারাদিন ঘুরে একেবারে সন্ধ্যার পর হোটেলে ফিরব। বেরিয়েছিলাম কেবলকারে চড়ব বলে। পথে দেখতে পেলাম একটা হেলিকপ্টার। ভাবলাম এতেই আগে চড়ে নিই। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম হেলিকপ্টারে চড়তে তিন জনের খরচ হবে ৪০০ রিঙ্গিত। আমরা রাজি হলাম। আট মিনিটের জন্য হেলিকপ্টারে চড়েছিলাম।সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা – আকাশ থেকে সমুদ্র আর ছোট ছোট সবুজ দ্বীপগুলিকে দেখা। তবে লাংকাউইর সব চেয়ে বড় আকর্ষণ কেবলকার। মূল গেটের সামনে মোটর সাইকেল পার্কিং করলাম। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলে পুরোটাই মার্কেট। জনপ্রতি ৩০ রিঙ্গিত দিয়ে টিকিট কেনা হলো। এবার ক্রমশ ওপরের দিকে উঠছি আমরা। যেতে যেতে দেখতে পেলাম একদিকে উঁচু পাহাড় আর অন্যদিকে বিস্তৃত সমুদ্রের উজাড় আলিঙ্গনের ছবি। অবশেষে ৭০০ মিটার উঁচুতে গিয়ে কেবলকার থেকে নামলাম। সেখানে স্কাই ব্রিজে পর্যটকদের ভিড়। স্কাই ব্রিজ থেকে সমুদ্রের দৃশ্য উপভোগ্য। আশে পাশে বিশাল উঁচু উঁচু পাহাড় আর সমুদ্র। যেদিকে চোখ যায় শুধুই সবুজ আর সমুদ্রনীল। দূরে দেখা যায় ছোট বড় জাহাজ – একে একে চলে যাচ্ছে আপন গতিতে। ২০০৪ সালে চালু হয়েছে স্কাই ব্রিজ। তার পর থেকেই লাংকাউইতে পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখ্যভাবে বাড়তে থাকে। স্কাই ব্রিজ থেকে অসংখ্য নিসর্গদৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করলাম। আরেকটি কেবলকারে করে নীচে নামলাম। এরপর প্রায় ১০ কিলোমিটার দুরে একটি পাহাড়ি ঝরনা দেখতে গেলাম। ভিতরে প্রবেশ করার সময় গেটের সামনে প্রচুর বন্য বানর দেখলাম। বানরগুলো খুব হিংস্র। বেশ সতর্কতা নিয়েই ভিতরে প্রবেশ করলাম। আঁকাবাঁকা সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে অনেকটা পথ উঠতে হলো। লক্ষ্য করলাম পাহাড় থেকে ঝরনার পানি নীচে গড়িয়ে পড়ার গতি খুবই কম। সেই ক্ষীণ জলধারাতেই অনেক দর্শনার্থী মনের আনন্দে গা ভিজাচ্ছেন। ঝরনা থেকে বেড়িয়ে এবার অনির্দিষ্ট গন্তব্যে ছুটে চলছি আমরা। মাইলের পর মাইল। মোটর সাইকেলের স্পীডোমিটারের কাঁটা ১৫০ ছুঁই ছুঁই। ফাঁকা রাস্তা। ছবির মতো সব দৃশ্য। পথের পাশে দৃষ্টিজুড়ে নীলাভ বিস্তীর্ণ সমুদ্র জলরাশি। মাথার ওপর সুবিশাল আকাশ, কখনো কখনো দুপাশেই বিশাল পাহাড়ের সমাহার। পাহাড়ের মাঝে মাঝে গভীর খাদগুলোর দিকে তাকালে গা শিউরে ওঠে। তবু আল্লার কী অপূর্ব সৃষ্টি এই প্রকৃতি! এরই মধ্যে বিকেল হয়ে এল। পথের এক প্রান্তে সমুদ্রের পাশে একটা খাবার হোটেলে থামলাম। ঘোরার আনন্দে দুপুরের খাবার খাওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। খাবার পেতে একটু দেরি হল। সি-ফুডের রান্না হতে সাধারণত দেরিই হয়। খেয়ে নিয়ে আশে পাশে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। এই বিচের সঙ্গে পান্তাই চেনাং বিচের মূল পার্থক্য হলো এখানে বিভিন্ন আকৃতির অসংখ্য পাথর আর প্রবালের উপস্থিতি। পাথরগুলো এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যেন সমুদ্রের গলায় মুক্তার মালা জড়ানো। এরই মধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো – পশ্চিম আকাশ রঙিন হয়ে উঠেছে। বেশ উৎসবমুখর পরিবেশ। সবাই সূর্য ডোবা দেখার অপেক্ষায়। পাথরের ওপর বসে সমুদ্রের গায়ে পা রাখতেই একচিলতে ঢেউ এসে ধুইয়ে দিয়ে গেল। যেন সমুদ্র সাম্রাজ্যে আগত বিশেষ কোনো অতিথি বরণ করে নেওয়া হল। ক্রমশ ঢেউ-এর তেজ বাড়ছে – সমুদ্র যেন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। অস্তগামী সূর্যকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন আগুনে ঝলসানো একটি লাল থালা ক্রমশঃ পশ্চিম দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। সূর্যাস্ত দেখছিলাম একমনে – হঠাৎ খেয়াল পড়ল চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। আমাদেরও ফিরতে হবে এবার। পরদিন সকালে নাস্তা শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম কেনা-কাটার উদ্দেশে। এখানে অনেক ডিউটি ফ্রি সপ আছে -এই দোকান গুলোতে খুব কম দামে নানান জিনিস পাওয়া যায়। লাংকাউইতে খাবারের দামও কম। টুকিটাকি শপিং করে হোটেলে ফিরে এলাম আমরা। দুপুর দুইটায় রুম ছাড়তে হবে। আজ আমাদের ফিরে যাওয়ার পালা। লাংকাউই ফেরি ঘাটে এসে মোটর সাইকেলের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে কুয়ালালামপুরের দিকে রওনা দিলাম। ভাবতে ভালোই লাগছিল প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে হয়তো নিজেকে কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ করতে পেরেছি। প্রকৃতি অবশ্য মানুষের থেকে অনেক বেশি উদার আর নিরহঙ্কারী।
সূএ: ইন্টারনেট
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.